মার্কিন গণতন্ত্রের প্রকৃত হুমকি কোনটা

ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার এক বছর পূর্তি হলো
ফাইল ছবি

২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, তার যথেষ্ট তথ্য এখনো জানা যায়নি। কিন্তু ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গাকারীদের উন্মত্ততায় এটা স্পষ্ট যে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফল বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে জো বাইডেন যে জিতেছেন, সেটার প্রত্যয়ন যেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স না দেন, সেই চেষ্টাই ট্রাম্প সমর্থকেরা করেছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল একটা ধোঁয়াশার পরিবেশ তৈরি করা, যাতে ট্রাম্পকে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আনা যায়।

কিন্তু ট্রাম্প সমর্থকদের এ পরিকল্পনা মাঠে মারা যায়। মাইক পেন্স, অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার এবং অন্য উচ্চপদস্থরাও ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করেননি। জর্জিয়া, মিশিগান, উইসকনসিন, পেনসিলভানিয়ার মতো রিপাবলিকান রাজ্যের কর্মকর্তা এবং একই সঙ্গে ফেডারেল আদালতের বিচারকেরা ট্রাম্পের পরিকল্পনায় সাড়া দেননি। প্রশাসন ও দলে বিরোধিতা সত্ত্বেও ট্রাম্প এমন রাষ্ট্রদ্রোহী পরিকল্পনা করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে একই ধরনের পরিকল্পনা আবার আঁটতে পারেন ট্রাম্প। তা সফল করতে গেলে কংগ্রেস, প্রাদেশিক আইনসভা ও ফেডারেল আদালতের শত শত রিপাবলিকান সদস্যের মধ্যে আঁতাত লাগবে। সেটা বাস্তবে ঘটলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।

যুক্তরাষ্ট্রে এমন ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনের মূল দায়িত্বে ট্রাম্প অনুসারী কর্মকর্তারা চলে আসতে পারেন। তাঁরা পেন্স ও বারের চেয়েও বেশি অনুগত ও সুশৃঙ্খল হবেন। কিন্তু সেটা করতে গেলে তাঁদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তাঁদের কর্মকাণ্ডের লাভটা এমন একজন কুখ্যাত ও অবিশ্বস্ত লোকের কাছে যাবে, যিনি জনগণকে তাঁর ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেন ও ছুড়ে ফেলেন।

রিপাবলিকান প্রার্থীদের ওপর ট্রাম্পের প্রভাব বাড়ছেই। তিনি সেই সব প্রার্থীকেই সমর্থন করছেন, যাঁরা প্রাইমারি কিংবা সাধারণ নির্বাচনে যেকোনো মূল্যে জিতে আসতে পারবেন। তবে ট্রাম্পের জনসমর্থনের ভিত্তি নিয়েও ধন্দ আছে। ট্রাম্প করোনার টিকা নিলে তাঁর অনেক সমর্থক প্রকাশ্যে তাঁকে টিটকারি করেন।

ধরা যাক, আগামী নির্বাচনে ট্রাম্প মনোনয়ন পেলেন এবং সর্বভাবে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেলেন। সে ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ-শ্রেষ্ঠত্ববাদী স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রথাগত নেতারাই রিপাবলিকান পার্টিতে প্রাধান্য বিস্তার করেন। এতে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা শাসন প্রথম দফার চেয়ে আরও বেশি অকার্যকর হতে বাধ্য।

যে কারণে মার্কিন গণতন্ত্র হুমকিতে—মার্কিন রাজনীতির শরীরে যে গভীর অসুখ, তারই উপসর্গ হিসেবে ট্রাম্পের মতো জনতুষ্টিবাদী নেতাদের উত্থান। তবে প্রকৃত হুমকি হচ্ছে দ্বিদলীয় মার্কিন রাজনীতিতে নেতাদের মুখের প্রতিশ্রুতি এবং বাস্তবে তার প্রয়োগের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। এ সমস্যাজনক পরিবেশ ট্রাম্পের মতো নেতাদের উত্থানে সহায়ক।

মুক্তবাজার অর্থনীতি বেশির ভাগ মার্কিনির জন্য নতুন ও ভালো মানের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। এর বদলে যুক্তরাষ্ট্র ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ নিত্যপণ্যের জন্য চীনসহ অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। গত তিন দশকে যুক্তরাষ্ট্র যেসব কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে, সেগুলোর সিংহভাগই নিম্ন মজুরির চাকরি। ২০০০ সালে মার্কিন তাত্ত্বিকেরা বলেছিলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এ অস্থিরতা স্থায়ীভাবে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু সম্পদের বুদ্‌বুদের ওপর গড়ে ওঠা অর্থনীতি ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মহামন্দা ডেকে আনে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ার ওপর মার্কিন আগ্রাসনের ফলাফল সরাসরি ব্যর্থতা বয়ে আনে।

এ বিশাল বিপর্যয়ের মূল কারিগরদের অনেকেই পরবর্তীকালে উপদেষ্টা পদে নিজেদের লোভনীয় ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন। যখন নীতিনির্ধারকেরা এ ধরনের বিপর্যয়ের হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না, গণমাধ্যমও এ ব্যর্থতায় নীরব ভূমিকা পালন করে, তখন নাগরিকেরা বিকল্প উৎস থেকে খবর খুঁজবে, সেটাই স্বাভাবিক। এ পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের মতো জনতুষ্টিবাদী নেতার উত্থান হবে, সেটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

আমেরিকার জনগণকে তাদের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার অনৈতিক প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু মার্কিন গণতন্ত্রের প্রকৃত হুমকি হচ্ছে দেশটির প্রথাগত রাজনীতিকেরা জন-আস্থা অর্জন করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • মাইকেল লিন্ড টেক্সাস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক