ইন্দো-প্যাসিফিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক ‘বাস্তব প্রতিযোগিতা’ শুরু হয়েছে। এ প্রতিযোগিতা ওই অঞ্চলের গুরুত্বকে সামনে নিয়ে এসেছে। বন্ধুরাষ্ট্র ও সহযোগীদের নিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠা নিয়ে অনেক কথাই বলা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া-যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা সহযোগিতা জোট বা আকাস-এর বিবৃতিতে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি নিয়ে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। এর আগে, কোয়াড সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের বক্তব্যেও সেটা স্পষ্ট হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক কালে নেওয়া খুব উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ এগুলো। এ বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বৈদেশিক নীতি বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, এ উদ্যোগগুলো তারই প্রতিফলন। সেই বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের নিজস্ব ধরনের শক্তির ওপর নির্ভর করে আমরা এগোব।’ কিন্তু কোয়াড, আকাস–সহ সাম্প্রতিক কালের পদক্ষেপগুলো থেকে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সরল এক অঙ্ক বেছে নিয়েছে। সেটি পাওয়া যাবে জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনে জো বাইডেনের বক্তব্যে। চীনের সঙ্গে ‘দায়িত্বশীল প্রতিযোগিতা’ করার কথা বলেন তিনি।
কোয়াডের মাধ্যমে ওয়াশিংটন ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি যথাযথ নীতি ও কর্মকৌশল প্রস্তাব করেছে। কোয়াডের প্রবিধানগুলো উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ। সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়গুলো এর প্রবিধানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ও স্বাস্থ্য, সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্যের আদান–প্রদান প্রভৃতি বিষয়গুলো এখানে যুক্ত করা হয়েছে।
‘দায়িত্বশীল প্রতিযোগিতা’-এর ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যে পরিষ্কার করে পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আগ্রাসী হবে যখন সেটা অনিবার্য হয়ে উঠবে, সহযোগিতামূলক হবে যখন সেটা দরকার পড়বে; কিন্তু সম্পর্কটা অবশ্যই দ্বন্দ্বমূলক হবে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা সব সময়ই দৃঢ়তা প্রদর্শন করব।’
বন্ধুরাষ্ট্র ও সহযোগী দেশগুলোকে সঙ্গে নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ‘দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা’ রক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা বন্ধুরাষ্ট্র ও সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করেছে।
চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার লক্ষ্য পূরণে যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী জোট গড়ে তুলেছে। ইন্দো–প্যাসিফিকে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলার জন্য তারা বেইজিংয়ের ওপর শক্ত চাপও সৃষ্টি করছে। সংঘাতের শঙ্কাও তারা সেখানে কমিয়েছে। ঠান্ডাযুদ্ধের ভীতিও এড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন একটি ‘সমন্বিত পরিকল্পনা’-এর নীতি গ্রহণ করেছে। এগিয়ে যাওয়ার জন্য সামরিক ও বেসামরিক দুটি ক্ষেত্রেই এই কৌশল তারা নিয়েছে। নিজেদের শক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটাচ্ছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বাস্তবায়নের জন্য ‘আকাস’ হচ্ছে জোটভিত্তিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। এটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতিকে নিশ্চিত করবে। অন্যদিকে কোয়াড হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ক্ষমতাবিন্যাসের অনন্য এক প্রকল্প।
মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থাগুলো থেকে চীন কী নিতে পারছে, সেটা যুক্তরাষ্ট্র এখন খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ করছে। আমেরিকার সম্পদ ও উদ্ভাবন (বিশেষ করে নৌ ও নজরদারি খাত) কী করে চীনের কোম্পানিগুলোর কাছে যাওয়া বন্ধ করা যায়, সে বিষয়টাতে তারা প্রখর নজর রাখছে। তারা চীনের টেক-জায়ান্ট হুয়াওয়ে ও জেটিই–এর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। চীনের ফাইভ-জি ব্যবস্থা যাতে না নেয়, সে জন্য জোট সঙ্গী ও সহযোগীদের কাছে দাবি জানিয়েছে।
কোয়াডের মাধ্যমে ওয়াশিংটন ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি যথাযথ নীতি ও কর্মকৌশল প্রস্তাব করেছে। কোয়াডের প্রবিধানগুলো উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ। সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়গুলো এর প্রবিধানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ও স্বাস্থ্য, সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্যের আদান–প্রদান প্রভৃতি বিষয়গুলো এখানে যুক্ত করা হয়েছে। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ মহাপরিকল্পনার বিপরীতে আমেরিকার নেতৃত্বে আরেকটা মহাপরিকল্পনার বীজ এখানে রয়েছে।
একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। বাইডেন প্রশাসন বুঝতে পেরেছে, জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড–১৯ মহামারি এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে গেলে চীনের সঙ্গে সমঝোতার বিকল্প নেই। এখানে একটা বিষয় বলতে চাই, ২০২০ সালেও চীন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার উত্তেজনা যদি স্থায়ী হয়, তবে দুই দেশ এই অঞ্চলে তাদের অংশীদার বাড়াতে চেষ্টা করবে। সে ক্ষেত্রে আসিয়ান গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল হয়ে উঠবে। আসিয়ানের দেশগুলো আমেরিকার সঙ্গে চীনের ‘দায়িত্বশীল প্রতিযোগিতা’র ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। এটাকে কাজে লাগিয়ে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বাড়াতে পারে। আলাপ-আলোচনা কিংবা আরও নতুন কোনো উপায়ে জোট হিসেবে কিংবা আলাদা দেশ হিসেবে আসিয়ান তাদের ভূমিকা পালন করতে পারে।
আসিয়ান এবং এই অঞ্চল, আমেরিকা ও চীনের মধ্যকার সর্বাত্মক প্রতিযোগিতাকে ‘দায়িত্বশীল প্রতিযোগিতায়’ রূপান্তর ঘটাতে পারে। সেটা নির্ধারণের সময় এখনই।
দ্য নেশন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ইরাম নাসির পাকিস্তানের ফোরম্যান ক্রিশ্চিয়ান কলেজের হিস্ট্রি অ্যান্ড পাকিস্তান স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক