রোবট কি মানুষের চাকরি খাবে?

রোবট সোফিয়া
রোবট সোফিয়া

সোফিয়া নামের এক রোবটের বাংলাদেশ সফরকালে মানুষের মধ্যে বিরাট উৎসাহ দেখা গেল। এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এটা খুবই স্বাভাবিক | তা ছাড়া বিশ্বে এখন চলছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। প্রযুক্তির বলেই শিল্পবিপ্লব ঘটে। চতুর্থটিতে ব্যবহৃত হচ্ছে রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো প্রযুক্তি ও বায়োটেকনোলজি। বিশ্বজুড়ে এ নিয়ে মহা হইচই চলছে। একটি প্রশ্ন উঠেছে: রোবটরা কি মানুষের চাকরি নিয়ে নেবে?

বাংলাদেশে কোথাও কোথাও রোবটের ব্যবহার শুরু হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে জেনেছি। তবে কি একদিন আমাদের পোশাক কারখানাগুলোতেও সারি সারি নারী-পুরুষের জায়গায় দেখব কয়েকটি করে রোবট? রেস্তোরাঁগুলোতে খাবার পরিবেশন করছে রোবট? ছোট ছোট দোকানগুলো আর নেই; কেনাকাটা চলছে বিশাল কয়েকটি বিপণিবিতানে, যেখানে বিক্রয়কর্মী মানুষ নয়, রোবট? 

অসংখ্য প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন বেকার লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার আগেই যদি বাংলাদেশে সত্যিই এ রকম ঘটে, তবে তা নিয়ে জাতির কর্ণধার ও নীতিপ্রণেতাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিল গেটস রোবট ব্যবহারের ওপর কর বসানোর পরামর্শ দিয়েছেন | উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটেনে শ্রমিকদের একটা গোষ্ঠী (Luddites) কাপড় বোনার যন্ত্র ভাঙচুর শুরু করে। কারণ, তারা মনে ভেবেছিল, এসব যন্ত্র ব্যবহৃত হলে তাঁতশ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়বে।

নতুন ও উন্নত প্রযুক্তি মানুষের কাজ নিয়ে নেবে কি না, এই প্রশ্ন কিন্তু বেশ পুরোনো | শ্রমের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবৃত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে ইদানীং গবেষণা হচ্ছে। এ বছর বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি ও সংস্থা কিছু গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যদিও তারা কেউ বলছে না যে আগামীকাল বা আগামী বছরই রোবটরা সবার চাকরি নিয়ে নেবে, তবু বিষয়টি সারা বিশ্বে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

কী বলা হচ্ছে এসব প্রতিবেদনে?

·সব পেশার প্রায় ৫ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণভাবে রোবটের মাধ্যমে করা যাবে। ৬০ শতাংশ পেশার অন্তত ৩০ শতাংশ কাজে রোবট ব্যবহার সম্ভব।

·কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তির ব্যবহার বেশি সম্ভব শিল্প, পরিবহন ও গুদামজাতকরণ, পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় ইত্যাদি খাতে | সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হবে জাপান, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। এ সম্ভাবনা কবে নাগাদ বাস্তবে পরিণত হতে পারে, সে বিষয়ে জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না। কোনো কোনো প্রতিবেদনে আগামী তিন-চার দশকের কথা বলা হয়েছে । কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুত হতে পারে; কোনোটিতে বলা হয়েছে এটা হবে বেশ মন্থর প্রক্রিয়া। কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে বলা যায়, কিছু চাকরি বিলুপ্ত হবে, কিছু নতুন ধরনের চাকরি সৃষ্টি হবে। সার্বিক প্রভাব ইতিবাচক না নেতিবাচক হবে তা বলা কঠিন। তবে অশিক্ষিত ও তুলনামূলকভাবে কম শিক্ষিত ব্যক্তিরা এই প্রক্রিয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। উচ্চশিক্ষিত ও বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিতরা ভালো অবস্থানে থাকবেন|

·নতুন প্রযুক্তির ফল যেন স্বল্প কিছু লোক বা শ্রেণির মধ্যে সীমিত না থাকে তা নিশ্চিত করতে এবং নেতিবাচক ফলগুলো যথাসম্ভব কমাতে সরকারি নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

নতুন প্রযুক্তি এবং যান্ত্রিকীকরণের ইতিহাস কী বলে?

প্রথম শিল্পবিপ্লবের সময় যান্ত্রিকীকরণের ফলে চাকরি কমেনি বরং বেড়েছে। ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত ব্রিটেনের বস্ত্রশিল্পে কর্মসংস্থান বেড়েছিল | বিশ শতকে তা কমে যাওয়ার কারণ যন্ত্র নয়। শ্রমের মজুরি বেড়ে যাওয়ার ফলে শিল্পটি প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছিল। তার ফলে উন্নয়নশীল দেশে শিল্পটির স্থানান্তর ঘটে।

তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান কমেনি, বরং বেড়েছে | মন্দার সময়গুলো বাদে সে দেশে কিন্তু চাকরির সংখ্যা কমেনি। এ বছরের নভেম্বর মাসেও দেশটিতে ২ লাখ ২৮ হাজার চাকরি যোগ হয়েছে, যা মাসিক গড়ের চেয়ে বেশি। আমাজন কোম্পানির কথা বিশেষভাবে বলা যেতে পারে, কারণ সেখানে রোবট ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেখানে সব সময়ই লোক নিয়োগ করা হচ্ছে |

কীভাবে এটা হয়?

একধরনের প্রযুক্তি মানুষের শ্রমের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। আবার এমন প্রযুক্তি আছে, যেগুলো শ্রমের পরিপূরক বা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সহায়ক। যেকোনো সময় দুই ধরনের প্রযুক্তিই ব্যবহৃত হতে পারে | কর্মসংস্থানে তার চূড়ান্ত ফল কী হবে তা নির্ভর করবে এই দুই শক্তির কোনটি বেশি প্রভাবশালী তার ওপর।

উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদিকা শক্তি বাড়ে, উৎপাদনের খরচ কমে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই পণ্যের দাম কমে। আর পণ্যের দাম কমলে আয় খুব না বাড়লেও বেশি পরিমাণে পণ্য কেনা যায়। দৈনন্দিন জীবনের কথাই ধরুন। পূর্বপুরুষদের তুলনায় আমাদের জামাকাপড়ের সংখ্যা অনেক বেশি। যাদের আয় বেড়েছে, তাদের তো কথাই নেই। ১০-১৫ বছর আগেও আমাদের অনেকের মুঠোফোন ছিল না; এখন এই ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এর উৎপাদন, বিক্রি ও রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যেসব চাকরি জড়িত, তার কথা কি আমরা দুই দশক আগে ভাবতে পারতাম? অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ব্যবহারের তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য ও সেবা; তাদের উৎপাদনের মাধ্যমে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।

বাংলাদেশের সামনে সুযোগ, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

অর্থনৈতিকভাবে রোবটের ব্যবহার যদি যৌক্তিক হয় তাহলে বাংলাদেশের জন্য তা কিছু ইতিবাচক ফল দিতে পারে | তবে সঙ্গে সঙ্গে কিছু চিন্তার বিষয় এবং চ্যালেঞ্জও থাকবে। সেগুলো মোকাবিলা করতে পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন হবে | প্রথমেই ইতিবাচক দিকগুলো দেখা যাক।

·যখন দেশের সব উদ্বৃত্ত শ্রম শেষ হবে এবং শ্রমিকের সরবরাহে ভাটা পড়বে, তখন এই প্রযুক্তি অবশ্যই কাজে আসবে | কিছু কাজ রোবটের মাধ্যমে করানো হবে, পাশাপাশি কিছু নতুন কাজের সুযোগ ও প্রয়োজন সৃষ্টি হবে। বিভিন্ন খাতে উৎপাদনক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়বে, ফলে পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা থাকবে। তার ফলে ভোক্তা উপকৃত হবেন। তাঁদের চাহিদা বাড়তে পারে; চাহিদা বাড়লে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে।

·শ্রমের উৎপাদিকা বাড়লে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির একটি পূর্বশর্ত পালিত হবে। তবে মজুরি আসলেই বাড়বে কি না, সেটা নির্ভর করবে শ্রমিক-মালিক দর-কষাকষি ও সরকারি নীতির ওপর। সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকলেও ভয় ও চিন্তা হলো এই যে ভ্রান্ত নীতিমালার কারণে শ্রমের সরবরাহে ঘাটতি হওয়ার আগেই রোবটের ব্যবহার শুরু হলে শ্রমবাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। রোবট ব্যবহারে প্রতিযোগী দেশগুলো এগিয়ে গিয়ে যদি প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে দেয়, তাহলে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে | সেটা দেখে সরকার তড়িঘড়ি রোবট ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়ার নীতি অবলম্বন করতে পারে | নতুন প্রযুক্তির ফলে অশিক্ষিত ও কম শিক্ষিত লোকজনের চাকরি হারানোর আশঙ্কা বেশি থাকবে| সুতরাং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ ব্যাপকভাবে সমাজের সব শ্রেণির মধ্যে প্রসারিত না হলে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বেড়ে যেতে পারে |

সুতরাং আমাদের সামনে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ হলো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে ভালো ফল পাওয়া যায় এবং সে সুফল যেন মুষ্টিমেয় কিছু লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে| এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নীতিনির্ধারকেরা সঠিকভাবে অবস্থা পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নীতিমালা অবলম্বন করে এই প্রক্রিয়াকে সঠিক পথে চালনায় সহায়তা করতে পারেন।

রিজওয়ানুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ।