৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের নির্বাচনে যে ফলাফল ধরে নেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে কিছু ব্যতিক্রম ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন-পরবর্তী নাটকের কারণেই হয়তো আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের নির্বাচন ও তার ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো আলোচনাও হয়নি। অথচ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের প্রচেষ্টার প্রেক্ষাপটে এ নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।
নির্বাচনের আগে ধারণা করা হয়েছিল যে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এবারও ক্ষমতায় থাকবে এবং বিরোধী দল হিসেবে ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) অবস্থান আগের তুলনায় জোরদার হবে। উল্লেখ্য, ইউএসডিপি সম্পূর্ণভাবে সেনাসমর্থিত এবং এই পার্টির সিংহভাগ প্রার্থীই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা বা সামরিক বাহিনী মনোনীত প্রার্থী। কিন্তু এবারের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, ইউএসডিপি দলটির অস্তিত্বই সংকটাপন্ন। গত নির্বাচনে (২০১৫) নিম্নকক্ষের ৪৪০টি আসনের মধ্যে ৩০টি আসন পেয়েছিল। স্মরণযোগ্য যে ১০০টি আসন মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত।
নির্বাচনের ফলাফল থেকে এটা পরিষ্কার যে এনএলডির জনপ্রিয়তা সব দিক থেকেই বেড়েছে এবং সামরিক বাহিনী–সমর্থিত ইউএসডিপির প্রতি জনগণ আস্থা হারিয়েছে। কিন্তু সংবিধানের কারণে সামরিক বাহিনীর প্রভাব থেকেই যাচ্ছে।
নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় এনএলডি নিম্নকক্ষের উন্মুক্ত ৩৩০ আসনে আগের চেয়ে ৩টি আসন বেশি পেয়েছে এবং এবার প্রাপ্ত আসন ২৫৮টি। উচ্চকক্ষের উন্মুক্ত ১৬৮ আসনের মধ্যেও আগের চেয়ে ৩টি বেশি পেয়েছে এবং এবার প্রাপ্ত আসন ১৩৮টি। অপর দিকে ইউএসডিপি নিম্নকক্ষে গতবারের চেয়ে ৪টি আসন হারিয়ে পেয়েছে ২৬টি এবং উচ্চকক্ষে ৪টি হারিয়ে পেয়েছে ৭টি আসন। কাজেই সহজেই অনুমেয় যে সেনাসমর্থিত দলের জনসমর্থন বেশ হ্রাস পেয়েছে, অপর দিকে সমর্থন বেড়েছে এনএলডির। স্মরণযোগ্য যে এবার নির্বাচনে উচ্চকক্ষের ৭টি এবং নিম্নকক্ষের ১৫টি আসন কথিত ‘ইমার্জেন্সি’ এলাকায় হওয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
স্টেট ও রিজিওনে মোট উন্মুক্ত ৬৬০ আসনের ৫০১টিতে এনএলডি জয়ী হয়েছে, অপর দিকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইউএসডিপি পেয়েছে মাত্র ৩৮ আসন এবং তার পরেই সান ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি পেয়েছে ২৭টি আসন এবং ৪৮ আসনে ‘ইমার্জেন্সির কারণে’ নির্বাচন হয়নি, এর বেশির ভাগই রাখাইন রাজ্যে। এখানে এনএলডির ২৫টি আসন বৃদ্ধি পেয়েছে, অপর দিকে ইউএসডিপির হ্রাস পেয়েছে মোট ৩৫টি আসন। এই হিসাব রাখাইনসহ ৭টি রাজ্য এবং ৭টি অঞ্চলের।
নির্বাচনের ফলাফল থেকে এটা পরিষ্কার যে এনএলডির জনপ্রিয়তা সব দিক থেকেই বেড়েছে এবং সামরিক বাহিনী–সমর্থিত ইউএসডিপির প্রতি জনগণ আস্থা হারিয়েছে। কিন্তু সংবিধানের কারণে সামরিক বাহিনীর প্রভাব থেকেই যাচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্টের সব কক্ষের ২৫ শতাংশ আসন সামরিক সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোট দ্বারা সংবিধান বদলানো আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। কাজেই সেনাবাহিনীর প্রভাব কমছে না।
ইউএসডিপির ভরাডুবি সামরিক বাহিনীর জন্য বিপর্যয়কর। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই নির্বাচনের আগে তাৎমাদো (সামরিক বাহিনী সদর) থেকে বলা হয়েছিল, নির্বাচনে কারচুপি হলে অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যা ইউএসডিপির পক্ষে যায়নি। ইতিমধ্যে ইউএসডিপি নির্বাচনী অনিয়মের প্রায় ৫০০টি অভিযোগ তুলেছে। কিন্তু নির্বাচনের পর সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং ইউএসডিপি থেকে দূরত্ব বজায় রাখছেন। বরং আরাকান আর্মি আরাকানের স্থগিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে দাবি জানিয়েছে, তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। অথচ নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনীর তরফে আরাকান আর্মির হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দেওয়ার দায়ে চীনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে এ ধরনের বক্তব্য ছিল অপ্রত্যাশিত। অনেকের ধারণা, সু চিকে কিছুটা বিব্রত করতে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
যাহোক, মিয়ানমারের কথিত বিরোধী দল ইউএসডিপির এমন শোচনীয় পরাজয়ের পর দলটির খুব একটা ভবিষ্যৎ আছে বলে মনে হচ্ছে না। অপর দিকে এনএলডির এই অভূতপূর্ব সাফল্যের পেছনে বেশ কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে এনএলডির প্রতি মিয়ানমারের বামার বুড্ডিস্ট ভোটারদের দারুণ সমর্থন রয়েছে। একই সঙ্গে কিছু কিছু প্রান্তিক এলাকায় সু চির প্রতিদ্বন্দ্বী কাউকে পাওয়া যায়নি। বিগত বছরগুলোতে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্বে সু চির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলে ধারণা হয়েছিল যে তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে পারে। কিন্তু তেমনটি হয়নি। কারণ, মিয়ানমারে সু চির পরিবর্তে আর কোনো নেতা নেই, যিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে মিয়ানমারের রাজনীতির জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করেছেন। জনগণ তাঁকে পরীক্ষিত নেতা হিসেবেই বিবেচনা করছে।
অনেকে মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়তো মিয়ানমারের জন্য সমস্যা হতে পারে। কিন্তু এ অঞ্চলের মার্কিন-চীন ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বাইডেন প্রশাসনের মিয়ানমার নীতিতে খুব একটা পরিবর্তনের সুযোগ নেই।
অনেকের ধারণা ছিল, আইসিজেতে মিয়ানমারের গণহত্যার সপক্ষে দাঁড়ানো এবং সেখানে তেমন সুবিধা করতে না পারায় সু চির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে, কিন্তু তেমন মোটেও হয়নি। বরং বামার জাতীয়তাবাদীরা তাঁর অবস্থানকে দারুণ ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছে। সু চি সরকার অর্থনৈতিকভাবে তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে বিপুল বিনিয়োগ আনতে পেরেছে। যদিও এখনো চীন বৃহত্তর বিনিয়োগকারী দেশ।
মিয়ানমার কোভিড নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু জনগণ প্রায় প্রতিদিন তাদের নেতাকে টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয়ে তাদের সচেতন করতে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে দেখেছে। সু চির অন্যতম সাফল্য বেশির ভাগ যুদ্ধরত গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং যুদ্ধবিরতি বজায় রাখা। তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তাঁর অপরিবর্তিত ও অনমনীয় অবস্থান উগ্র বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ও বামার বৌদ্ধদের তুষ্ট করেছে।
তবে আগামী বছর এপ্রিল মাসে সু চি যখন নতুন সরকার গঠন করবেন, তখন তাঁর সামনে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ থাকবে। প্রথমত, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক হবে। ইতিমধ্যে সামরিক বাহিনী আরাকান আর্মির সঙ্গে শান্তি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে, যা এনএলডি প্রত্যাখ্যান করেছে।
আরও বড় চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ। তবে সু চি তাঁর নতুন শক্তির কারণে সে চাপকে তেমন কোনো গুরুত্ব দেবেন বলে মনে হয় না। কারণ, তাঁর নির্বাচনী ম্যান্ডেটে এমন কিছু ছিল না। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কিছু রোহিঙ্গাকে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে, কিন্তু এটা বাংলাদেশের সংকট দূর করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করবে না। তা ছাড়া মিয়ানমারে অন্তরীণ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্বের প্রশ্ন অমীমাংসিতই থেকে যাবে। দেশে সু চির জনপ্রিয়তা ও গণতন্ত্রের তকমার কারণে ঘনিষ্ঠ দেশগুলো রোহিঙ্গা সংকট নিষ্পত্তির জন্য মিয়ানমারকে তেমন চাপ দেবে বলে মনে হয় না।
অনেকে মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়তো মিয়ানমারের জন্য সমস্যা হতে পারে। কিন্তু এ অঞ্চলের মার্কিন-চীন ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বাইডেন প্রশাসনের মিয়ানমার নীতিতে খুব একটা পরিবর্তনের সুযোগ নেই।
রোহিঙ্গা সমস্যা ক্রমেই বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কাজেই বাংলাদেশকে তার নিজের বিকল্প পথগুলোর কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে হবে। এ সমস্যা সহজে সমাধান হবে, এমন আশা করা যায় না।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)