শিক্ষায় দলাদলি, দলবাজি ও সমূহ সর্বনাশ

গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পঞ্চাশে বাংলাদেশ: অতীত-বর্তমান এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক বক্তৃতায় খ্যাতনামা লেখক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শিক্ষাব্যবস্থার দীনতা ও দুর্বলতা নিয়ে এমন কিছু কঠিন সত্য কথা বলেছেন, যা সাধারণত আমাদের শিক্ষাবিদেরা বলেন না। তাঁরা সমস্যার মূলে না গিয়ে আশপাশ দিয়ে যান, গা বাঁচিয়ে কথা বলেন। আর শিক্ষার যাঁরা অভিভাবক হয়ে বসেছেন, তাঁরা ভাবেন, দেশের সব মানুষ নির্বোধ, তাদের যা বোঝানো হবে, তা-ই বুঝবেন, যা শেখানো হবে, তা-ই শিখবেন। কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা যাবে না, করলেও কখনো উত্তর মিলবে না।

আলোচনার সুবিধার্থে সেদিন সেমিনারে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কী বলেছেন, তার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি। তিনি কোনো রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, ‘আমরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখন বিসিএস চর্চায় আছি। আমি বলি, বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হোক। সেখানে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, ভাইভা ইত্যাদি বিভাগ থাকবে। দারুণ চলবে কিন্তু। সবচেয়ে জনপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাবে সেটা। ...বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টর ইত্যাদি হওয়ার জন্য আজকে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি। আমি মনে করি, আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে। আমরা সব সময় অন্যের দিকে হাত তুলি, নিজের দিকে তুলি না। সমালোচনা যদি সবার নিজের ভেতর থেকে শুরু হতো, তাহলে এত হতাশা থাকত না (প্রথম আলো, ২০ মে ২০২২)।’

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বক্তৃতায় আরও অনেক কথা বলেছেন, যা পত্রিকায় আসেনি। এলে প্রথম আলোর পাঠক তথা দেশবাসী উপকৃত হতেন। এখন সময়টা এমন যে মানুষ সহজ-কালাকে কালা ও সাদাকে সাদা বলতেও ভয় পান; কিন্তু সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অকপট সত্য কথা বলেছেন। আমরা শিক্ষাব্যবস্থাটিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছি, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি কেন্দ্র।

স্বাধীনতার পর দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যেসব মেধাবী শিক্ষার্থী বের হয়েছেন, আমরা যদি তার সিকি ভাগও ধরে রাখতে পারতাম, তাহলে দেশের এমন দুর্গতি হতো না। ওই একই সেমিনারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘৫০ বছরে বাংলাদেশে যা হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি।’ রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি, বিচার বিভাগ, আইনসভা, প্রশাসন—কোথাও হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা স্নাতক পাস করার আগে থেকে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সেটি অবশ্যই দোষের নয়। কথা হলো যখন উচ্চশিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে পড়ে বিসিএস, তখন এত বিশ্ববিদ্যালয়, এত বিভাগ ও অনুষদের কী প্রয়োজন?

কয়েক দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, ইউজিসি (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করেছে। এই টাকা ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নয়, জনগণের। অতএব টাকাটা কীভাবে, কোথায় খরচ হবে, তা থেকে কী সুফল পাওয়া যাবে, তা জানার অধিকার তাঁদের আছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন।

আরও পড়ুন

এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজ ও মাদ্রাসায় মোট ৩১ লাখ ৫০ হাজার ৪০৯ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। আর প্রতিবছর বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে কমবেশি দুই হাজার পরীক্ষার্থী চাকরি পান। নন-ক্যাডারে আরও দুই আড়াই হাজার। এই সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ইউজিসি ১০ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠবে।

আমাদের শিক্ষার মূল গলদটা তুলে ধরেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেরা শিক্ষার্থীরা কেন সবকিছু বাদ দিয়ে বিসিএস পরীক্ষার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বেন? এর একটি কারণ অন্য ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ খুবই কম। থাকলেও সেটি তাঁদের অধীত বিদ্যার উপযোগী নয় কিংবা বেতন-ভাতা অসম্মানজনক।

প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদদের বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে ব্যাপক হারে যোগদানের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এক পক্ষ বলেছেন, তাঁরা পরীক্ষায় ভালো ফল করেই পছন্দসই ক্যাডার বেছে নিয়েছেন। এ অধিকার তাঁদের আছে। অপর পক্ষ বলেছেন, সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে বিশেষায়িত শিক্ষার তফাত আছে। বিশেষায়িত শিক্ষার পেছনে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকের ব্যয়ের চেয়ে রাষ্ট্রের ব্যয় অনেক বেশি। যাঁরা বিশেষায়িত শিক্ষা নিয়ে বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি নেন, তাঁদের যুক্তি হলো বিসিএস ক্যাডারে সুযোগ-সুবিধা বেশি। ক্ষমতা আরও বেশি। বিশেষায়িত ক্যাডারের কোনো চাকরিজীবী নিজেকে কখনো প্রশাসন ক্যাডারের সমকক্ষ ভাবতে পারেন না মেধা ও বিদ্যায় এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও। পদায়ন ও পদোন্নতির জন্য প্রশাসনের কাছেই তাঁদের ধরনা দিতে হয়। সরকারও প্রশাসন ক্যাডারকে যত বেশি গুরুত্ব দেয়, অন্যান্য ক্যাডার তত বেশি নিজেদের ‘অচ্ছুত’ ভাবে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কেবল ‘বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়’ নিয়ে কথা বলেননি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে দলবাজির কথা বলেছেন। উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য পদের জন্য শিক্ষকদের মধ্যে যে দলাদলি আছে, তা–ও উল্লেখ করেছেন। কেবল দলাদলি নয়, দলের ভেতরে উপদল আছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে উপদলের এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের গুরুতরও অভিযোগও আনছে।

আরও পড়ুন

সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ক্ষমতাসীন দলের পাল্লা ভারী। ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষক সমিতির নির্বাচনেও তাঁরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত হয়ে আসেন। তারপরও দলাদলি, দলবাজি ও দালালি বন্ধ হয় না। কে কাকে কীভাবে ল্যাং মারবেন, সেই চেষ্টায় থাকেন। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় তিয়াত্তরের অধ্যাদেশের বাইরে আছে, সেখানকার শিক্ষকেরা পদ পাওয়া ও রক্ষার জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের কাছে নিয়মিত ধরনা দিতেও দ্বিধা করেন না।

আমাদের উচ্চশিক্ষা সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে না বলেই মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষার জন্য উন্মুখ থাকেন। যেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন, সেখানে শিল্পোদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে বেশি বেতন দিয়ে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়ে আসছেন নিজেদের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে। অভিযোগ, সেখানে যে মানের কর্মী দরকার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তা জোগান দিতে পারে না। তাই বিদেশ থেকে কর্মী আনতে হচ্ছে।

এটা হলো মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠ হলো আমাদের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেধাবী শিক্ষার্থীদের বড় অংশ বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এর একটি কারণ হলো দেশে তাঁরা যোগ্যতার দাম পান না। দ্বিতীয়ত, দেশে থাকলে দলবাজি করতে হয়। দলবাজি ছাড়া চাকরি হয় না। বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে বহু মেধাবী শিক্ষার্থী দেশে ফিরে এসেও থাকতে পারেননি দলাদলির কারণে। এই দলাদলি ও দালালি কেবল শিক্ষাঙ্গনে সীমিত নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যেও গেড়ে বসেছে। সম্প্রতি আলাপ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এখানে ব্যবসা করতে যেসব অনৈতিক কাজ করতে হয়, প্রতিটি পদে ক্ষমতাসীনদের কাছে ধরনা দিতে হয়, সেটা প্রবীণেরা মেনে নিলেও তরুণেরা মানতে নারাজ। এ কারণেই তাঁরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। অর্থ পাচারের চেয়েও ভয়ংকর হলো মেধা পাচার। এ ধারা চলতে থাকলে দেশের সর্বনাশ অবধারিত।

স্বাধীনতার পর দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যেসব মেধাবী শিক্ষার্থী বের হয়েছেন, আমরা যদি তার সিকি ভাগও ধরে রাখতে পারতাম, তাহলে দেশের এমন দুর্গতি হতো না। ওই একই সেমিনারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘৫০ বছরে বাংলাদেশে যা হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি।’ রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি, বিচার বিভাগ, আইনসভা, প্রশাসন—কোথাও হয়নি।

কেন হয়নি, সেই প্রশ্নের জবাব কি এখন যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, অতীতে ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁরা দেবেন?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]

আরও পড়ুন