শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথিতে প্রার্থনা

করোনাকাল চলছে। বিশ্বজুড়ে মানুষ বিধিনিষেধে অতিষ্ঠ। বছর পেরিয়ে গেলেও মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না। আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটছে প্রতিনিয়ত। মহামারি আর ঘোর দুর্যোগের মধ্য দিয়ে দুয়ারে হাজির বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা শ্রীভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি, যা সবার কাছে জন্মাষ্টমী নামে পরিচিত। এই মাহেন্দ্রক্ষণে ভক্তদের প্রার্থনা, একদিন সৃষ্টিকর্তার ইঙ্গিতেই শেষ হবে এই মহাদুর্যোগ। আবার মানুষ ফিরে পাবে তার স্বাভাবিক জীবন।

সর্বাপেক্ষা যিনি বৃহৎ, তিনিই ভগবান। বেদে তাঁর পরিচয় ব্রহ্ম। এত বড় যে তিনি আমাদের নাগালের বাইরে। আমাদের ষড় ইন্দ্রিয়, আমাদের ক্ষুদ্র মন, আমাদের সংকীর্ণ বুদ্ধি—এসবের তিনি বহু ঊর্ধ্বে। তাঁকে পাওয়া আমাদের সাধ্যের বাইরে, তবে তাঁকে পাওয়ার জন্য ভক্তের নিরন্তর আকুলতা সৃষ্টিকর্তার মনেও দোলা না দিয়ে পারে না। এ সমস্যা সমাধানে তিনি নিজেই নিত্য ও অনুগ্রহ শক্তির প্রেরণায় ‘অনুগ্রহায় ভূতানাং’। কৃপা করে তিনি এলেন এই ধূলির ধরায়, আমাদের দুয়ারে। ভগবান অবতরণ করলেন মানুষের ঘরে, করুণায় বিগলিত হয়ে। সীমাহীন ধরা দিলেন সীমানার কিনারে, মানুষ সেজে। পরম ব্রহ্ম শুদ্ধাভক্তি দেবকী ও শুদ্ধসত্য বাসুদেবের ঘরে কৃষ্ণ রূপে পুত্র পরিচয়ে।

শ্রীকৃষ্ণ তাঁর জন্ম নিয়ে নিজেই বলেছেন ‘মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায় কিন্তু আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান হয়ে থাকি। আবির্ভূত হওয়া এবং অন্তর্হিত হওয়া দুটোই আমার অলৌকিক লীলা।’ গীতার কথামতো ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের বৃদ্ধির তাৎপর্য হলো ভগবদ্ প্রেমী, ধর্মাত্মা, সদাচারী, নিরপরাধ এবং মানুষের ওপর নাস্তিক, পাপী, দুরাচার, বলবান ব্যক্তিদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাওয়া এবং মানুষের মধ্যে সদ্‌গুণ সদাচার অত্যন্ত কমে গিয়ে দুর্গুণÑদুরাচারের অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীকে কলুষমুক্ত করতে কংস, জরাসন্ধ ও শিশুপালসহ বিভিন্ন অত্যাচারিত রাজাদের ধ্বংস করেন এবং ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

শ্রীকৃষ্ণ যখন আবির্ভূত হন, তখন পৃথিবীতে বহু ধর্মমত ও উপধর্মমত প্রচলিত ছিল। যে সনাতন যোগধর্ম অনেকবার প্রচারিত হয় এবং লয়ও হয়, শ্রীকৃষ্ণ তাই আবার প্রচলন করলেন। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, ‘হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি তত্ত্বতঃ জানেন, তিনি দেহত্যাগ করে আর জন্মগ্রহণ করেন না, তিনি আমাকেই পেয়ে থাকেন।’ আমরা শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের নেপথ্যে তাকালে দেখতে পাই, পুরাণাদিতে অবতারের অসুরবিনাশের যে লীলা বর্ণনা আছে, ধর্ম-সংস্থাপন বলতে কেবল তা–ই বোঝায় না। ধর্মের দুটি দিক আছে—বাহ্য বা ব্যবহারিক এবং অভ্যন্তরীণ বা আধ্যাত্মিক।

শ্রীকৃষ্ণ-অবতারেরও দুটি উদ্দেশ্য, দুটি দিকের একটি হচ্ছে অন্তর্জগতে মানবাত্মার উন্নতিসাধন, অপরটি হচ্ছে বাহ্যজগতে মানবসমাজের রাষ্ট্রীয় বা নৈতিক পরিবর্তন সাধন। বেদে বলা আছে ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, নিরাকার, জ্যোতির্ময়, সর্বত্র বিরাজমান এবং সর্বশক্তিমান। বেদজ্ঞ জ্ঞানী ঋষিরা নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করে থাকেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাকার ঈশ্বরের উপলব্ধি করা খুবই কঠিন কাজ। এরপরও মানুষই সেই অসাধ্যকে সাধন করছে।

মহাকাল ও মহাজগৎ ব্যাপ্ত হয়ে যিনি অনন্ত সর্বশক্তিমান সত্তায় শাশ্বত সত্যরূপে বিরাজিত, আমরা তঁাকেই ভগবান বলে থাকি। কেবল সনাতনী কল্প মনীষাতেই তিনি অষ্টোত্তর শত নামে সম্ভাষিত হয়েছেন। ভক্তরা তাঁকে যে নামে ডাকেন, সে নামে তিনি সাড়া দেন। যেভাবে তাঁকে পেতে চান, সেভাবেই তিনি ধরা দেন। সনাতনী সমাজে তাঁর অবস্থান অনেকটা পরিবারের একজনের মতো। তাই তো তিনি দেবকী ও বসুদেবের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে কংসের কারাগারে তাদের সম্মুখে আবির্ভূত হন পুত্ররূপে, কৃষ্ণ নামে।

শ্রীকৃষ্ণ পুরুষোত্তম। পুরুষের ভেতরে যিনি উত্তম, তিনিই পুরুষোত্তম। শ্রীকৃষ্ণ পুরুষোত্তম হয়ে এসেছিলেন মানুষের সার্বিক কল্যাণের নিমিত্তে। দুরাচারদের বধ করে ধর্মমনা মানুষের সাধনার পথ সুগম করতে। তাঁরই পথ ধরে বলতে হয় সব ধর্মের মর্মবাণীই এক এবং অভিন্ন। মৌলিক বিষয়ে কোনো প্রভেদ নেই। প্রভেদ যা কিছু মূলত প্রথাগত ও আনুষ্ঠানিকতায়। ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, তিনিই সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান, তিনি পরম করুণাময়। ধর্মেও এই মূলমন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্বের কল্পিত অহংকার থেকে জন্ম নেয় মানুষে মানুষে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বৈরিতার। ধর্ম সম্বন্ধে মানুষের সংকীর্ণ জ্ঞানই ধর্মে ধর্মে এমনকি একই ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে হানাহানিতে পৃথিবীর মাটি আজ রক্তস্নাত, মনুষ্যত্ব বিপর্যস্ত, শান্তি বিঘ্নিত। সবকিছুরই একদিন অবসান হবে পালনকর্তার ইচ্ছায়। এই করোনা মহামারি, মহাদুর্যোগেরও অবসান হবে ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভক্তি আর সততার রসে সিক্ত হয়ে।

তারাপদ আচার্য্য সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ