সংলাপে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ আবশ্যক

.
.

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে যে মন্তব্য করেছেন, তার মধ্যে সমঝোতার সুরটা আছে। তিনি প্রকারান্তরে বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তাব নিয়ে রাষ্ট্রপতির মধ্যস্থতা বা তাঁর উদ্যোগে একটা নীতিগত আলোচনায় সম্মতি দিয়েছেন বলে আমরা মনে করি। তা ছাড়া, হলি আর্টিজানের বিয়োগান্ত অধ্যায়ের পরে দেশে আপাতত শান্ত রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রয়েছে বলা চলে। আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কার্যকরভাবে জঙ্গিশক্তিকে পর্যুদস্ত করেছে।

আমাদের জীবন থেকে আতঙ্ক আপাতত দূর হয়েছে, যদিও হুমকি আছে ও থাকবে। অস্ট্রেলিয়া, যারা যুক্তরাষ্ট্রসহ কতিপয় পশ্চিমা দেশকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে থাকে, তারা চলতি সপ্তাহে নতুন করে সতর্কতা জারি করেছে। কিন্তু যেটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আমরা একটি স্থিতিশীল পরিবেশ অতিক্রম করছি এবং এ অবস্থাটিকে যাতে আমরা ধরে রাখতে পারি, সে জন্য একটা রাজনৈতিক আপস দরকার।

সামাজিক নৈরাজ্য, সন্ত্রাস ও উগ্রপন্থার মূল শিকড় রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই সুপ্ত থাকে। সুতরাং র‍্যাব-পুলিশের আপাত সাফল্যকে কোনোভাবে দেশের রাজনীতিকে একটা অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক না করার কোনো বিকল্প হতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন পেশাদার রাজনীতিকদের পেশাদারি আচরণ করতে হবে। আর সে জন্য প্রধান করণীয় হলো, আর কালক্ষেপণ না করে নির্বাচনী সংলাপ চালিয়ে যাওয়া।

বিএনপিকে আলটিমেটামের ও ভোট বর্জনের রাজনীতি এবং সরকারি দলের বিরোধী দলের প্রতি দমনমূলক আচরণ, গ্রেপ্তার ও
হয়রানি করার মনোভাব পরিহার করতে হবে। সাম্প্রতিক কয়েকটি জামিনের ঘটনায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে বলে মনে করা হয়।

এর আগে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবের ভিত্তিতে কতগুলো রাজনৈতিক অগ্রগতির কথা লিখেছিলাম। এখন বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংযত মন্তব্য উৎসাহব্যঞ্জক মনে হচ্ছে।

খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই আমাদের একটি মোটামুটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক ধারায় ফিরতে হবে। সে জন্য বর্তমান সংসদ বৈধ কি না, সেই প্রশ্ন এখন ভুলে থাকলেও চলে। আবার কোনো কৌশলগত চাহিদা পূরণ বা যেনতেনভাবে একটা মধ্যবর্তী নির্বাচন করারও কোনো দরকার দেখি না।

প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, মধ্য পার হয়ে গেছে। তবে সংকট অন্যত্র। এর আগে দুই দলের অংশগ্রহণে যেমন নির্বাচন হয়েছে, সেখানে কিন্তু বোঝাপড়াটা কম ছিল। সমঝোতা ও আপসকে বাদ দিয়ে সংবিধান ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে বড় করে দেখা হয়েছিল। সেটা মনে রাখতে হবে। ত্রয়োদশ সংশোধনী রাত-বিরাতে পাস হয়েছিল। আলোচনার টেবিলে হয়নি। পরে পাঁচ বছর পর পর ‘সরকারের পতন’ ছিনিয়ে এনেছে বিরোধী দল, তারপর তারা জয় পেয়েছে। সেই রাজনীতির একটা অবসান ঘটেছে।

২০১৩ সালে বিএনপির রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে চাওয়া আর ২০১৬ সালে যেতে চাওয়ার মধ্যে কিছু একটা মৌলিক পার্থক্য আছে মনে হয়। এ ধারণা ভুলও হতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করে নেওয়ার রাজনীতিটা তারা চালু করতে অপারগই থাকছে। তবু ভাবতে ভালো লাগছে, এর আগে তাদের টার্গেট ছিল নির্বাচন বয়কট করা ও সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করা। এবারে তারা সম্ভবত বঙ্গভবনে যেতে চাইছে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য।

সংবিধান সংস্কৃতি ছাড়া অচল। রাষ্ট্রপতির যা এখতিয়ার ও ঐতিহ্যগতভাবে এখতিয়ার আছে, তাতে দেশের বর্তমান অবস্থায় একটা আলোচনা চালাতে পারেন। তিনি বিবেচনায় নিতে পারেন: প্রথমত, খালেদা জিয়া যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা আর লিখিতভাবে বলেননি, তাই ধরে নেওয়া যায় যে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসেছেন।

দ্বিতীয়ত, এর আগে যতবারই নির্বাচন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের চেষ্টা হয়েছে, ততবারই বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের বাইরে যাওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। এই প্রথম একটা রাজনৈতিক সংকট থেকে বেরোতে শতভাগ সংবিধানসম্মত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

তৃতীয়ত, ১৯৯৬ এবং ২০০৬-০৭ সালের সুষ্ঠু নির্বাচনবিষয়ক আন্দোলনে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতির ভূমিকা স্বীকার করেনি। এর আগের নির্বাচনে বিএনপি রাষ্ট্রপতির ওপর ভরসা করতে চেয়েছে এবং দ্বিতীয়বারের মতো তারা রাষ্ট্রপতিকেই মেনেছে।

চতুর্থত, শেখ হাসিনার আরেকটি সাফল্য হলো, বিএনপি তাঁর পদত্যাগ বা পতন চাইছে না। বাংলাদেশে রাজনীতির একটি চিরচেনা স্লোগান হলো গদি থেকে নামানো বা পতন না ঘটানো পর্যন্ত (এতেই বিরোধী দল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার মনে করে) তাঁরা বাড়ি ফিরবেন না। এই মেজাজ নেই।

পঞ্চমত, বিএনপি মধ্যবর্তী বা আগাম নির্বাচন চাইছে না।

রাষ্ট্রপতি জামায়াতকে অবশ্যই ডাকবেন না। সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ অবশ্য বলতে চান যে, জামায়াত নিবন্ধনহীন দল কি না, তা এখনো তর্কসাপেক্ষ। তিনি মনে করছেন বিএনপির প্রস্তাব অনুসরণ করলে রাষ্ট্রপতিকে জামায়াতের সঙ্গেও আলোচনায় বসতে হবে।  বিএনপিকে এখন সুনির্দিষ্টভাবে  বলতে হবে জামায়াতকে না ডাকলে তাদের গাত্রদাহ হবে না।

যাক সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবু আমরা বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়েই পথ চলব। জামায়াতকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপতির একটা আলোচনা শুরু না করার কোনো কারণ দেখি না। সুতরাং আমরা তাঁর ডাক শোনার অপেক্ষায় থাকব। ব্যর্থ সংলাপও গণতন্ত্র শক্তিশালী করে।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷