জাতীয় প্রেসক্লাবসহ সাংবাদিকদের ৬টি সংগঠনের ১১ জন নেতার ব্যাংক হিসাব চাওয়ার ঘটনাটি নিয়ে এখন ঘরে-বাইরে সরগরম আলোচনা হচ্ছে। ঘর বলতে সরকারের ভেতরের কথা বলতে চাইছি। ঘরের বাইরের লোকেরা তো সরকারের সমালোচনা করবেই। কিন্তু ঘরের ভেতরের একেকজন একেক কথা বলছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ভাষ্য ভাষ্য হলো: সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব চাওয়ার ঘটনা অপ্রত্যাশিত। ভবিষ্যতে আর এমনটি হবে না। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তো শুরু থেকে বলে আসছেন ব্যাংক হিসাব চাইলেও সাংবাদিক নেতাদের ভয়ের কিছু নেই। তাদের অযথা হয়রানি করা হবে না। কিন্তু সতেরো কোটি মানুষের মধ্যে ১১ জনের ব্যাংক হিসেব চেয়ে চিঠি দেওয়া কি হয়রানি নয়?
আমরা এক অদ্ভুত গণতান্ত্রিক দেশে বাস করছি। বিরোধী দল কার্যত নিষ্ক্রিয়, নাগরিক সমাজকেও নিশ্চুপ করে দেওয়া হয়েছে। এখন সংবাদমাধ্যমকে নির্বাক করে দিতে পারলেই ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য সফল হয়। ব্যাংক হিসাব তলবের কারণ কারও অজানা নয়। কঠোর বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে এখনো কোনো কোনো সাংবাদিক সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন। ভবিষ্যতে তারা যাতে সেটি না করতে পারেন, সে জন্যই এই চিঠি। এর মাধ্যমে অন্যান্য পেশার মানুষকে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে যে সরকারি দলের নেতা ও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যত অন্যায়ই করুন না কেন, মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। কোনো প্রতিবাদ করা যাবে না।
ক্ষমতাসীনেরা ৫০ বছর ধরে সংবিধানের নামে জনগণের অধিকার খর্ব করে এসেছেন। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে অতীতে একাধিকবার সেনাশাসন জারি করা হয়েছে। আবার নির্বাচিত সরকারগুলোও সেনা শাসকদের রেখে যাওয়া পথেই হেঁটেছেন। তাদের চেয়ে কোনো উন্নত শাসনকাঠামো তৈরি করতে পারেনি।
ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতা দোহাই দিচ্ছেন, সরকার চাইলে যেকোনো ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব চাইতে পারে। কিন্তু আইনানুযায়ী সরকার এভাবে যে কোনো নাগরিকের ব্যাংক হিসাব তলব করতে পারে না, সে কথা ড. শাহদীন মালিক সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ তুলে ধরে দেখিয়েছেন। প্রথম আলোয় তাঁর কলামের শিরোনাম ছিল ‘সাংবাদিকেন ব্যাংক হিসাব তলব ও বেচারা সংবিধান’।
ক্ষমতাসীনেরা ৫০ বছর ধরে সংবিধানের নামে জনগণের অধিকার খর্ব করে এসেছেন। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে অতীতে একাধিকবার সেনাশাসন জারি করা হয়েছে। আবার নির্বাচিত সরকারগুলোও সেনা শাসকদের রেখে যাওয়া পথেই হেঁটেছেন। তাদের চেয়ে কোনো উন্নত শাসনকাঠামো তৈরি করতে পারেনি। গণতন্ত্রের সিপাহশালাররা সেনা শাসকদের বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তুললেও সংবিধানে তারা যেসব ক্ষত রেখে গিয়েছেন, তা বহাল রেখেছেন।
সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করার পর ব্যাংকের ভোল্টেজ থেকে কোটি কোটি টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার খবর এসেছে। প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন লিখেছেন, এটি হলো ব্যাংক ডাকাতির নতুন পদ্ধতি। বাংলাদেশ ব্যাংক নিরীহ সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব না চেয়ে ব্যাংক ডাকাতদের প্রতি নজর দিলে ভালো হতো। অন্তত ব্যাংক ডাকাতির বদনাম থেকে দেশ রক্ষা পেত।
ক্ষমতায় আসার আগে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে কী অঙ্গীকার করেছিল তা একবার মন্ত্রী-সাংসদদের পড়ে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি। তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করেছিলেন। দুর্নীতি কমেনি। তারা মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করেছিলেন। মাদক ও সন্ত্রাসও কমেনি। তারা সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওয়াদা করেছিলেন। সুশাসন ও জবাবদিহির অংশ হিসেবে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল: ‘প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সাংসদদের সম্পদের হিসাব প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।’ কিন্তু অদ্যাবধি সেই কাজটি আওয়ামী লীগ সরকার কখনো করেনি (ব্যতিক্রম ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। দায়িত্বে থাকাকালে তিনি প্রতি বছর আয় ব্যয়ের হিসাব ওয়েবসাইটে দিয়ে দিতেন)। যখন সাংবাদিকেরা মন্ত্রী -সাংসদদের সম্পদের হিসাব দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, তখন ক্ষমতার শীর্ষ থেকে বলা হয়েছে, মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের হিসাব তো প্রতিবছর জাতীয় রাজস্ব বিভাগে দেওয়া হয়। নির্বাচনের সময় হলফনামায় সেই হিসাব থাকে। মন্ত্রীদের হিসাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া আছে।
সরকারের এই পরিবর্তিত মনোভাব দেখে একটি বহুল প্রচলিত গল্প মনে পড়ল। এক লোকের ছেলে কঠিন অসুখে পড়লে তিনি দেবতার কাছে মিনতি করে বললেন, ‘তুমি আমার ছেলের অসুখ ভালো করে দাও, আমি তোমার নামে একটি মহিষ দেব।’ পরে শিশুটি রোগমুক্ত হলো। কিন্তু ওই লোক দেবতাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেলেন। আরও কিছুদিন এভাবে কেটে গেল। দেবতা তাকে প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিলে লোকটি বলেন, ‘মহিষ দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। তুমি একটি ছাগল নাও।’ কিন্তু লোকটি যখন ছাগলও দিল না, তখন দেবতা আবার তাকে প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য ফের তাগিদ দিলেন। এরপর লোকটি বললেন, ‘ছাগল নয়, একটি মুরগি দেব।’ দেবতা তাতেও রাজি হলেন না। কিন্তু লোকটি মুরগিও দিলেন না। বললেন, ‘মুরগি নয়, একটি ফড়িং দেব।’ জবাবে দেবতা বললেন, ‘তাহলে তুমি ফড়িংই দিও।’ কয়েক দিন পর দেবতা তাকে প্রতিশ্রুতি রক্ষার কথা বললে লোকটি এই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন যে, ‘দেবতা, তুমি এত ক্ষমতাবান, একটি ফড়িং ধরে নিতে পারো না?’
নির্বাচনের আগে নেতারা প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন। ভোটের জন্য অনুনয়, বিনয় করেন। কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর আর জনগণকে চেনেন না। আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকাশ্য ঘোষণা দিলেন জনসমক্ষে মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের হিসাব দেওয়া হবে। এখন তারা রাজস্ব বোর্ড ও নির্বাচনী হলফনামার গল্প শোনান।
বাংলাদেশের জনগণের অবস্থা হয়েছে গল্পে উল্লিখিত দেবতার মতো। তারাশঙ্করের বিখ্যাত উপন্যাস গণদেবতা। সেই গণদেবতা ছিল শক্তিমান। কিন্তু আমাদের পূর্বাপর সরকারগুলো জনগণ নামক দেবতার পরোয়া করে না। নির্বাচনের আগে নেতারা প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন। ভোটের জন্য অনুনয়, বিনয় করেন। কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর আর জনগণকে চেনেন না। আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকাশ্য ঘোষণা দিলেন জনসমক্ষে মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের হিসাব দেওয়া হবে। এখন তারা রাজস্ব বোর্ড ও নির্বাচনী হলফনামার গল্প শোনান।
১২ বছর আগে আওয়ামী লীগ দিনবদলের সনদ দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। এই ১২ বছরে সাধারণ মানুষের দিন কতটা বদল হয়েছে জানি না, কিন্তু সরকারি দলের নেতা, সরকারের উচ্চ পদে আসীন ব্যক্তিদের দিন যে শনৈঃশনৈঃ বদল হয়েছে, তা খোলা চোখেই দেখা যায়।
সরকারের নিজেদের লোকদের সম্পদের হিসাব যাতে কেউ চাইতে না পারেন, সে জন্যই যে সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে বলেই অনেকের ধারনা। সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সাংবাদিক সমাজ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। তথ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে তারা এই কর্মসূচি স্থগিত করেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে মৌখিক আশ্বাস ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি। সরকার সেই চিঠি এই কলাম লেখা পর্যন্ত প্রত্যাহার করেনি। মন্ত্রীরা যা-ই বলুন না কেন, সরকার যাঁরা চালান তাঁরা আদৌ তাদের পাত্তা দেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি