ব্যক্তির মতো সমাজ ও রাষ্ট্রও কখনো কখনো বিকারগ্রস্ত ও ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে। বিকার দেখা দিলে অথবা রোগগ্রস্ত হলে প্রয়োজন চিকিৎসার। যথাসময়ে রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা না নিলে অবস্থার অবনতি ঘটাই স্বাভাবিক। বাঙালি সমাজ আজ মারাত্মকভাবে অসুস্থ এবং তার মধ্যে বিকার দেখা দিয়েছে।
১৯৫০-৫১ সালে বিত্তবান সচ্ছল উচ্চশ্রেণির হিন্দুদের দেশত্যাগের স্মৃতি আমার অম্লানই রয়েছে। তাঁরা সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে কলকাতায় চলে গেছেন, পালিয়ে যাননি। তাঁদের বড় বড় বাড়িঘর, জোতজমি হয় কলকাতার কোনো মুসলমানের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ বা বিনিময় করেছেন অথবা মুসলিম লীগপন্থী প্রভাবশালী কারও কাছে অল্প দামে বিক্রি করে গেছেন। এভাবে বাংলাদেশে বা পূর্ব বাংলায় একটি বিত্তবান মুসলমান শ্রেণি গড়ে ওঠে। তাঁরা রাজনৈতিকভাবেও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হন। পাকিস্তান ছিল ঘোষিত ইসলামি রাষ্ট্র, সেখানে মুসলমানরাই যে শাসকশ্রেণি হবেন, তা অবধারিত। প্রভাবশালী হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা সেটা মেনে নিতে পারেননি, তাঁরা ভারতে চলে গেছেন। কারণ, হিন্দুপ্রধান ভারতে হিন্দুরাই হবেন শাসক, অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী নয়।
১৯৫২-র গ্রীষ্মকালে প্রথমবার ঢাকায় এসে নারিন্দা, ওয়ারী, ফরাশগঞ্জ, পাটুয়াটুলী, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, ইসলামপুর, চকবাজার, লালবাগে হিন্দু-মুসলমানের একটি যৌথ সমাজ দেখেছি। বিকেলবেলা ইসলামপুরের দোতলা বাড়িগুলোর ঝুলবারান্দায় দেখতাম হিন্দু মহিলারা বসে গল্প করছেন। প্রবীণ মহিলাদের কেউ তাঁদের কন্যা বা নাতনির চুল বেণি করে দিচ্ছেন। হেঁটে বা ঘোড়ার গাড়িতে আমরা রাস্তা দিয়ে যেতাম। নির্মল সামাজিক পরিবেশ। বড় ভালো লাগত। ষাটের দশক নাগাদ সেই সামাজিক পরিবেশ আর রইল না। নবাবপুরের দোতলা বাড়ির বারান্দায় আর দেখা যেত না ধোপদুরস্ত কাপড় পরা হিন্দু নারীদের।
প্রথম ঢাকায় এসে আব্বার সঙ্গে দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখতে যেতাম। লালবাগ কেল্লা, বড় কাটারা, ছোট কাটারা, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকেশ্বরী মন্দির, কার্জন হল, হাজি শাহবাজের মসজিদ, রমনা কালীমন্দির, হাইকোর্টের প্রাঙ্গণে হজরত চিশতি বেহেস্তির মাজার প্রভৃতি। হাজি শাহবাজের মসজিদ থেকে কালীবাড়ির মন্দিরের দূরত্ব আড়াই শ গজ। কী করে দুই ধর্মাবলম্বীর দুটি উপাসনালয় অত পাশাপাশি থাকতে পারে, তা নিয়ে তখন ভাবার প্রয়োজন বোধ করিনি। কারণ, বাঙালি সমাজে, বাঙালির সমন্বিত সংস্কৃতিতে তা ছিল স্বাভাবিক।
হঠাৎ কিসের মধ্যে কী হলো, ১৯৬৪ সালে দেখা দিল উত্তেজনা। আমরা তখন থাকতাম আজিমপুর কলোনির পাশে লালবাগ শাহি মসজিদের কাছে। বৃহত্তর লালবাগ-শেখ সাহেব বাজার, আমলীগোলা, চৌধুরী বাজার, জগন্নাথ সাহা রোড, শ্রীনাথ স্ট্রিট প্রভৃতি এলাকায় অনেক হিন্দু মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ী বাস করতেন। লালবাগ ঋষিপাড়া প্রভৃতি এলাকায় নিম্নবর্ণের হিন্দুরা থাকতেন। তফসিলি হিন্দুদের পেশা ছিল জুতা-স্যান্ডেল বানানো। ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুবিরোধী পৈশাচিকতা দেখা দেয়। ক্ষমতাসীন দল ও গোষ্ঠীর তাতে থাকে মদদ। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নেতারা বসে রইলেন না। তাঁরা রাস্তায় নামলেন। কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরাও ঘরে বসে রইলেন না। বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা, কবি জসীমউদ্দীনসহ অনেকেই হিন্দুদের জানমাল রক্ষায় রাস্তায় নামলেন। তাঁরা রাস্তায় লিফলেট বিলি পর্যন্ত করলেন। আমাদের মতো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব নিল। সন্ধ্যার আগে খেয়েদেয়ে আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে হিন্দুদের বাড়িঘর, ঋষিপাড়া প্রভৃতি সারা রাত পাহারা দিতাম। এসএম হল ও ফজলুল হক হলের ছাত্ররা জগন্নাথ হলের ছাত্রদের নিরাপত্তায় অতন্দ্র জেগে থাকতেন। মনে আছে, একদিন রাত ১২টা/১টার দিকে রাশেদ খান মেননের শ্বশুর কেরামত আলী সাহেব ও পাড়ার কয়েকজন মুরব্বি কেল্লার মোড়ে আমাদের দেখতে আসেন ঠিকমতো পাহারা দিচ্ছি, নাকি পাহারা দেওয়ার নাম করে কোথাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি।
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর শাসকশ্রেণির মধ্যে ভারত-বিরোধিতা থেকে হিন্দু বিরূপতায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। যুদ্ধটা হয় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে, মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যে নয়। কিন্তু পাকিস্তানে হিন্দুরা এবং ভারতে মুসলমানরা সন্দেহভাজন নাগরিকে পরিণত হন। যাঁরা ওই সময় কোনো কারণে দেশের বাইরে ছিলেন, তাঁদের সম্পত্তি রাষ্ট্র নিয়ে নেয়। শুধু তা-ই নয়, সে সম্পত্তির নাম দেওয়া হয় এনিমি প্রপার্টি, যার বাংলা ‘শত্রুসম্পত্তি’। হিন্দু সংখ্যালঘু নাগরিকেরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। পাকিস্তান সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করে। তার ফলে গঠন করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যালঘু কমিশন’। পঁয়ষট্টির সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পর ওই কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রাদেশিক শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী দেওয়ান আবদুল বাসেত এবং কমিশনের দুজন সদস্য ছিলেন আবদুল আলিম ও গৌরাঙ্গচন্দ্র সাহা।
আমাদের এলাকার নন্দী পরিবারের প্রগতিশীল রাজনীতিক মন্মথনাথ নন্দী, প্রমথনাথ নন্দী, ভবেশ নন্দী, পুলিশ কর্মকর্তা ব্রজগোবিন্দ নন্দী প্রমুখের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁদের কেউ কংগ্রেসের সঙ্গে, কেউ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে মুসলিম লীগের নেতাদের সঙ্গেও তাঁদের সুসম্পর্ক ছিল। একবার আমার মনে আছে, সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে চট্টগ্রামের এমপিও পুলিন দে ও গৌরাঙ্গ সাহার সঙ্গে ওয়ারীর এক বাড়িতে নন্দীদের বৈঠক হয়। পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যালঘু কমিশন কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু তা বাস্তবায়নের আগেই উনসত্তরে আইয়ুবের পতন ঘটে এবং তারপর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। ভেবেছিলাম রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতাটা বুঝি দূর হবে।
ষাটের দশকে দেখেছি কি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কি সামাজিক বিকার, যেকোনো দুর্যোগে ছাত্র-যুবসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যেত। কোথাও ঘূর্ণিঝড়, বন্যা হলেও ছাত্রনেতারা ছুটে যেতেন। ছাত্রসমাজের যেমন ছিল প্রতিবাদী চেতনা, তেমনি ছিল গণভিত্তি। ছাত্র ইউনিয়ন ছিল অবিচল, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। ছাত্রলীগ ছিল জাতীয়তাবাদী। দুটি সংগঠনের নেতারাই প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুর্যোগে মানুষের পাশে ছুটে যেতেন। তাঁরা দলের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতেন না। উনসত্তরের পয়লা বৈশাখ ডেমরায় এক ঘূর্ণিঝড়ে কয়েকটি গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে যায়। হাজার খানেকের বেশি মানুষ মারা যায়। সরকারি ত্রাণ তৎপরতা শুরুর আগেই ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা সেখানে ছুটে যান। দুই দিন পরে আমি সেখানে গিয়ে দেখি গ্রামের ভেতরে দুর্গত মানুষের মধ্যে কাজ করছেন সাইফুদ্দিন মানিক, পঙ্কজ ভট্টাচার্য প্রমুখ নেতা। কবি জসীমউদ্দীনের ছেলে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা জামাল আনোয়ার (বাসু) প্রমুখও ছিলেন খুবই তৎপর। ঢাকায় এসে ইকবাল হলে দেখি ছাত্রলীগের নেতা মাজহারুল হক বাকী, নীলফামারীর আবদুর রউফ প্রমুখ দুর্গত লোকজনকে কীভাবে সাহায্য করা যায়, তার জন্য বৈঠক করছেন। রোকেয়া হল ও ইডেন কলেজের ছাত্রীরা পুরোনো কাপড়চোপড় সংগ্রহে রাস্তায় নেমেছেন।
রামুর নারকীয়তার পরে হালের নাসিরনগরে যা ঘটল, তাতে লজ্জায়-দুঃখে মাথা নত হয়ে আসে। দিনেদুপুরে কোনো নাগরিকের বাড়িঘরে আগুন জ্বলবে, লুট হবে, খুন-জখম হবে—তা অবিশ্বাস্য। একাত্তরে দেখেছি পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার আলবদর সদস্যরা হিন্দুদের এবং স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া পাকিস্তানি আমলেও দিনদুপুরে হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন জ্বালাতে দেখিনি। সমাজবিরোধীরাই করুক আর প্রশাসনের প্রশ্রয়ে সরকারি দলের ক্যাডাররাই করুক, দেশের ছাত্র-যুব সংগঠনের নেতা-কর্মীরা গেছেন কোথায়? ছাত্রলীগ, যুবলীগ, অগণিত অমুক লীগের সাইনবোর্ডে সারা দেশ ভরে গেছে। নেতাদের ছবিসংবলিত বিলবোর্ডে রাস্তাঘাট, গাছপালা, দোকানপাট সয়লাব। নাসিরনগরে তারা রাস্তায় থাকলে কোনো দুর্বৃত্তই দুঃসাহস দেখাতে পারত না। টেন্ডারের বাক্স কোথায় আছে, সেখানে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কুরুক্ষেত্র সৃষ্টি করতে দেখা যায় প্রায় প্রতিদিন; গাঁদাবন্দুক-পিস্তল ছাড়া শুধু লাঠি নিয়ে নাসিরনগরের গ্রামের মধ্যে টহল দিলে হিন্দু পরিবারগুলো নিরাপত্তাহীনতায় বিপন্ন হতো না।
সবকিছুর মূলে নষ্ট রাজনীতি। অনুদার রাজনীতির কারণে সামাজিক আন্দোলনের নেতারাও পলিটিকসে জড়িয়ে পড়েছেন। বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমাজ। সরকারি দলের সমর্থক সেক্যুলাররা চান সমাজে শুধু তাঁদেরই অাধিপত্য ও প্রাধান্য থাকবে। অন্য দলের লোকেরা যত অসাম্প্রদায়িকই হোন, তাঁদের কোনো মূল্য নেই। এটা ভুল নীতি। সরকারি দলের অনুগত লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা দেশের কোনো এলাকায় যখন সফরে যান, তাঁরা গিয়ে নিজেদের দলের লোকেদের বাড়িতে ওঠেন। নিজেরা নিজেরা আলোচনা করেন। সমস্যার সমাধান চাইলে কথা বলতে হবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে। প্রতিপক্ষ যদি ভুল পথে চলে, তাদের ভুল ভাঙানোই প্রগতিশীলদের দায়িত্ব। ভিন্নমতের মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়ে সংঘাতমুক্ত শাক্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
যারা উপমহাদেশের নষ্ট রাজনীতির বলি, যারা পড়ে আছে সমাজের নিভৃত প্রান্তে, যারা অসহায়, যারা দুর্বল, তাদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য নষ্ট মানুষদের সঙ্গে যদি কিছুটা আপস করতে হয়, তা–ও করতে হবে। কিন্তু গভীর সমস্যার সমাধান বক্তৃতা দিয়ে, মানববন্ধন করে হবে না, গান গেয়ে হবে না, নাটক করেও নয়। বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে ছাত্র-যুবসমাজকে।
স্রোতস্বিনী নদীতে স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকলে নানা জঞ্জাল নদীর পানি পচিয়ে দেয়। সেখানে জমে শৈবাল ও দাম। নদী মরে যায়। একটি জাতির জীবনও নদীর মতো। তার সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মপ্রবাহ নদীর স্রোতের মতো। স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্রোত যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন নানা বিকার ও জঞ্জাল স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে।
যেকোনো ধরনের সামাজিক বিকারের মূল কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। প্রতিপক্ষের নিন্দায় শক্তিক্ষয় হয়, অসহায় মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। পারস্পরিক বাগ্বিতণ্ডায় দুর্বল আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়বে। সমস্যা থেকেই যাবে। উদার সংবেদনশীল মন ও সত্যানুসন্ধানই পারে গভীর সামাজিক-রাজনৈতিক অসুস্থতাকে নির্মূল করতে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।