হুতাশে মরলেন বেলারুশি, আমাদের তো কই মাছের প্রাণ

করোনা পরীক্ষার রিপোর্টে বারবার গোলমাল দেখে হতাশায় আত্মহত্যা করেন বাংলাদেশে অবস্থানকারী এক বেলারুশী নাগরিক
প্রতীকী ছবি

যদি তিনি অন্য কোনো কারণে আত্মহত্যা করেন, তাহলে কোনো কথা নেই। করোনাভাইরাসের কোমল ছোঁয়ায় কঠিন ধরা খাওয়ার জন্যও যে আত্মহত্যা করেছেন, খবরে তারও কোনো উল্লেখ নেই। তিনি আত্মহত্যা করেছেন অনিশ্চয়তার ফাঁদে পড়ে। তাঁর কি করোনা হয়েছে? নাকি হয়নি? হয়েছে? নাকি হয়নি? খবরে প্রকাশ, ৭/৮ বার তাঁর করোনা টেস্ট করা হয়। প্রথমবারেই যদি বোঝা যেত তাহলে তো হতোই। কিন্তু বিয়েবাড়ি সাজানো মরিচবাতির মতো একবার যদি নেগেটিভ আসে, পরেরবার আসে পজিটিভ। এই লারেলাপ্পা ‘চালতেই রাহে’ ‘চালতেই রাহে’। ফাইনালি তিনি আর কী করবেন। রাজধানীর ধানমন্ডির যে প্রখ্যাত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বেশ কিছুদিন ছিলেন, তাতে হাসপাতালটির অনেক লাভ হলেও জীবনটা তিনি ‘লস’ করে ফেলেছেন। বেলারুশের এই ভদ্রলোক ধারাবাহিক পজিটিভ/নেগেটিভের ফাঁদে পড়ে এমনই হতাশ যে হলেন, আর না পেরে ওই হাসপাতালের ষষ্ঠ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করলেন।

ঘটনাটা মর্মান্তিক। তাঁর ও তাঁর পরিবারের জন্য শোকাবহ। আমাদের সাধের বাংলাদেশ থেকে তিনি প্রাণ নিয়ে ফিরলেন না, সে জন্য দুঃখিত হওয়াই উচিত। তবে প্রবাদের কথামতো ভগবান যেমন পাকেচক্রে ভূত হয়ে যান, তেমনি শক্তিশালী মানুষও এই দেশের পরিস্থিতিতে নাকানি–চুবানি খেতেই পারেন।

বঙ্গদেশে একে বলে ‘হুতাশে মরে যাওয়া’। পাঁচবিবির এক গ্রামের বাজারে গিয়ে শুনেছিলাম, ২০১৮ সালের নির্বাচনের দিন সেখানকার এক বিদ্যালয়ের দারোয়ান নাকি হুতাশে মরে গিয়েছিলেন। কী হবে না হবে, কোন পক্ষ নেবেন বা না নেবেন, ইত্যাকার গন্ডগোলের মধ্যে ভোটকেন্দ্রে হামলা হলে তিনি সোজা দৌড় দেন। কিন্তু পথ তো সরল না কখনো। তাঁর সোজা দৌড়ের মাঝখানে পড়ে ছিল একটা পুকুর। তিনি তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং ভয়ে বা ‘হুতাশে’ হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান।

এটা হয়। মানুষ যখন পথের দিশা পায়, তখন আর হতাশ হয় না। কিন্তু পথের খোঁজে গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে মনে ‘হুতাশ’ ধরে যায়—জ্বালা ধরে যায়, হতাশা আসে। সেই হতাশায় কেউ কেউ আত্মহত্যাও করে।

২১ জুনে বিবিসি বাংলার খবর, ‘ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়া একজন কোভিড-১৯ রোগী আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।’ ভদ্রলোক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বাসায়ও ফেরেননি। পথিমধ্যে আত্মহত্যা করেছেন। এই হলো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মনস্তাত্ত্বিক সুরতহাল রিপোর্ট।

বেলারুশ নামের ওই দেশের নাগরিক আমাদের রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করছিলেন। করোনাভাইরাস তাঁর দেহে বসত করেছে; সে মতো লক্ষণ দেখে তিনি রাজধানীর সেই প্রখ্যাত হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানকার চিকিৎসকেরা যার আর পর নাই তেমন যারপরনাই ভাবে বুঝতে চাইছিলেন যে ভদ্রলোকের আসলে কী হয়েছে। যদি করোনা হয়! এই সম্ভাবনার মুখে তাঁরা তাঁর কোভিড–১৯ টেস্ট করান। এই টেস্ট তো আর অভিজাত হাসপাতালেও হওয়ার নয়, এটা করে সরকারের বিশেষ অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। সেইসব প্রতিষ্ঠান এমনই প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠিত হয়েও তাঁদের কোনো পরীক্ষাই এটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারল না যে বেলারুশের নাগরিকটির আসলেই করোনা হয়েছে কি হয়নি। একেক দিন পরীক্ষার একেক ফল দেখে ভদ্রলোক বোধ হয় অজ্ঞেয়বাদী হয়ে পড়েছিলেন। দর্শনের যেই ধারা মনে করে যে সত্য আসলে জানা যায় না, তাদের অজ্ঞেয়বাদী বলে।

কিন্তু এহেন দার্শনিক বিলাস তো আর জীবন–মৃত্যুর প্রশ্ন নিয়ে করা যায় না। যদি করোনায় আক্রান্ত হন, তাহলে একরকম, নাহলে আরেক রকম ব্যবস্থা। কিন্তু রোগই যখন চেনা গেল না, তখন চিকিৎসা আর কী হবে। এই জটিলতার ফেরে পড়ে মানুষটা আত্মহত্যা করে বসলেন।

তবে আত্মহত্যাকারী বাঙালি ও বেলারুশি আসলে ব্যতিক্রমী ধরনের মানুষ। অসুখ হয়েছে কি হয়নি, বাঁচব কি বাঁচব না, সেই ফেরে পড়ে আত্মহত্যা করার ‘মুরদ’ বাঙালির নেই। এক টুকরা জমি নিয়ে বাঙালি পুরুষ অর্ধশতাব্দী কাল আদালতের বারান্দায় কাটিয়ে দিতে পারে। যত দিন শ্বাস, তত দিন আশ; এই হলো বাংলাদেশিদের মূলনীতি। আমরা সহজে হার মানি না। এই যেমন আমরা জানি না, আসলেই কোভিড–১৯ নামের মহামারির কোন পর্যায়ে আমরা আছি। এখানে করোনা লক্ষণাক্রান্ত অধিকাংশ মানুষ আর হাসপাতালেই যাচ্ছেন না, টেস্টও করাচ্ছেন না। জনগণ এখানে সরকারি পরীক্ষা–নিরীক্ষা কিংবা হাসপাতালের চিকিৎসায় ভরসা করছে না। করোনা এখানে জাতীয় নয়, ব্যক্তিগত। একেক জনের করোনার লক্ষণ যেমন একেক রকম, একেক জনের গ্রহণ করা চিকিৎসাপদ্ধতিও একেক রকম। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ, ইউনানি, ভেষজ, প্রাকৃতিক এবং অতিপ্রাকৃতিক—বিবিধ পদ্ধতি অবলম্বন করছেন ভুক্তভোগীরা। এই বৈচিত্র্য এই বহুত্ববাদী আরোগ্যপদ্ধতি আছে যাঁদের, তাঁরা মরবেন তবু আত্মহত্যা করবেন না।

শতেক নৈরাজ্য, অনিয়ম, সাগরসমান দুর্নীতি সত্ত্বেও বাংলাদেশিরা উন্নয়নে আস্থাশীল। একের পর এক বিতর্কিত নির্বাচনের পরও মহান বাংলাদেশি গণতন্ত্র কই মাছের প্রাণ নিয়ে বেঁচে আছে। সব খাতেই যুগান্তকারী নয়–ছয়ের পরও পরিসংখ্যান বলছে ‘সব ঠিক আছে’। তাই করোনাভাইরাসে ইতালি বা আমেরিকার মতো দেশ কাবু হয়ে গেলেও আমরা ভাইরাসের চেয়েও শক্তিশালী প্রমাণ করতে স্কুল–কলেজ ছাড়া সবকিছু খুলে দিয়েছি। কই কোনো হইচই আছে? পরিবেশ তো অতীব সুন্দর। এই সুন্দর পরিবেশের প্রমাণ, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, চুরি–দুর্নীতি প্রভৃতি করোনা–পূর্ব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে।

বেলারুশি ভদ্রলোকের দেশে এখন গণতন্ত্রের আন্দোলন চলছে। স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে লাখো মানুষ রাজপথ ময়দান ছয়লাব করে স্লোগান তুলছে। এটা তাঁদের ধৈর্যহীনতারই প্রমাণ। কই বাংলাদেশে কত কিছু হয়ে গেলেও তো সবকিছু সুনসান। কারণ, বাঙালির প্রাণ ও বাংলাদেশি গণতন্ত্র কই মাছের মতো। পানি থেকে ডাঙায় তোলার পরও যেমন কই মাছ অনেকক্ষণ বেঁচে থাকে, তার সুবাদে বাজারে আমরা তাজা কই মাছ কিনে খেতে পারি, তেমনি করোনায় মরলে মরব, তবু আমরা আত্মহত্যা করব না।

বাঙালির এই শক্তির অপর নাম সহনশীলতা, এটা আমাদের শরীর ও মনে যথেষ্টই আছে। বাঙালিকে আমরা এ জন্যই মহাশয় বলে সম্বোধন করি। মহা যন্ত্রণাও যার সয়, সে–ই তো মহাশয়।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।

[email protected]