চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় গোটা জাতি স্তব্ধ। এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের নয়জন কর্মীসহ চল্লিশের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। কোনো ঘটনায় এতজন অগ্নিনির্বাপণকর্মীর মৃত্যু এটিই প্রথম। আহত দুই শতাধিক মানুষ, যঁাদের অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন, অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। কনটেইনারে লাগা আগুন নেভানোর সময় যে বিস্ফোরণ ঘটে, তার প্রথম শিকার হন অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা। অনিয়ম, দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতির কারণেই যে অগ্নিকাণ্ড থেকে এত বড় বিস্ফোরণ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, সেটা প্রাথমিকভাবে স্পষ্ট।
অগ্নিকাণ্ডের সূচনার পর আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এটা জানতেন না যে সেখানে রাসায়নিকভর্তি কনটেইনার রয়েছে। কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষের তরফেও বিষয়টি তাদের জানানো হয়নি। কনটেইনার ডিপোর ভেতরে কনটেইনার রাখার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতা কাজ করেছে। আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী, সাধারণ পণ্যবোঝাই কনটেইনার ও রাসায়নিকের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যবোঝাই কনটেইনার একসঙ্গে থাকার কথা নয়। এখানে সেই নিয়ম কার্যকর ছিল না বলেই অগ্নিকাণ্ডের সূচনার পর বিভ্রান্তি তৈরি হয় এবং তার মর্মান্তিক শিকার হন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এ ছাড়া ডিপোটিতে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ও শ্রমিক নিরাপত্তার প্রটোকলের ব্যাপক ঘাটতির বিষয়টিও পরিষ্কার।
পোশাক খাতে একের পর এক দুর্ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতাগোষ্ঠীর চাপে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কমপ্লায়েন্স (সার্বিক মান) পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে অন্যান্য পণ্য উৎপাদন কারখানাগুলোর অবস্থা কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা টের পাওয়া গিয়েছিল রূপগঞ্জে খাদ্যপণ্যের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়। এবার সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায়ও দেখা গেল সেই একই অনিয়ম, নিয়মকানুন মেনে না চলা ও সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের চরম দায়িত্বহীনতা।
শ্রম আইন অনুযায়ী, বড় ধরনের কোনো স্থাপনা বা কারখানার অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকা বাধ্যতামূলক। দাহ্য পদার্থ বা ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যের মাত্রা ও মজুতের বিষয়টি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব মাথায় রেখে সম্ভাব্য ঝুঁকির দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। দেখা যাচ্ছে, আইনে সব ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও কার্যত কোনো কিছু মানা হয় না। সীতাকুণ্ডের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম অগ্নিকাণ্ডের শুরু থেকেই শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। শুরুতেই শ্রমিক-কর্মচারীদের বের করে নিয়ে এলে এত প্রাণহানি ঘটত না। উল্টো আমরা দেখতে পাচ্ছি, গেটে তালা লাগিয়ে পালিয়েছিলেন নিরাপত্তাপ্রহরী। প্রতিটি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এই একটি কারণেই বিপুল প্রাণহানি আমরা দেখতে পাচ্ছি।
ডিপোটির তদারকির দায়িত্ব অনেকগুলো সরকারি কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে; বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার দায় সবাইকে নিতে হবে। আগের দুর্ঘটনাগুলোতেও সরকারি তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর গাফিলতি ও অনিয়ম বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু দায়মুক্তি তাদের জন্য যেন নির্ধারিত। এসব ঘটনার ক্ষেত্রে সরকারিভাবে ও নাগরিক উদ্যোগে নানা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, তাঁরা অনেক সুপারিশ করেন। কিন্তু শেষমেশ সেসব কিছুই মানা হয় না এবং এই জবাবদিহিহীন পরিস্থিতি আরেকটি দুর্ঘটনার পথ তৈরি করে। কবে আমাদের সরকার ও তদারকি সংস্থাগুলোর হুঁশ হবে? নাকি এভাবেই চলবে?
সীতাকুণ্ডের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতি আমরা গভীর সমবেদনা জানাই। আহত ব্যক্তিদের যথাযথ সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। আশা করি, সে ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি হবে না। একই সঙ্গে হতাহত শ্রমিক ও তঁাদের পরিবার যাতে প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।