আসলামুলের নদী দখল

সম্পাদকীয়

বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের জমি রক্ষায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন শুধু একাই প্রতিবেদনটি তৈরি করেনি। জেলা প্রশাসন, বিআইডব্লিউটিএ, জরিপ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের মতো সংস্থার উপযুক্ত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত টিম সরেজমিনে সাক্ষ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে করেছে। আর তাতে সন্দেহাতীতভাবে সাংসদ আসলামুল হকের ‘ব্যক্তিগত উন্নয়ন’যজ্ঞ বেআইনি এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের শামিল বলেই প্রতীয়মান হয়।

তবে এ প্রসঙ্গ আসলামুল হকের কাছে তোলামাত্র তিনি যেভাবে উচ্চ স্বরে হেসে উঠেছেন, সংবাদ সম্মেলন করে নদী কমিশনকে ‘শত্রু ও দুশমন’ চিহ্নিত করেছেন, তাতে শুধু নদী রক্ষা কমিশন নয়, কার্যত দেশের সব সরকারি সংস্থার ওপর তার অমার্জনীয় তাচ্ছিল্য ফুটে উঠেছে। উন্নয়ন প্রকল্প ভালো। কিন্তু এ ‘উন্নয়ন’ কার এবং তা কিসের বিনিময়ে?

নদী ও জলাশয় চিরকালীন সর্বজনীন সম্পদ। কোনো আইনি দলিল কখনো জেনে বা না জেনে তৈরি হলেও তা গোড়া থেকে বাতিল বলে গণ্য হবে। এর নাম জাস্টিনিয়ান কোড। আড়াই হাজার বছর আগের এ কোড বিশ্বের সব উচ্চ আদালতে স্বীকৃত ও অনুসরণীয়। তাই সাংসদের মুখে কথিত বৈধতার ভিত্তি মিউটেশন (নামজারি), সিএস রেকর্ড, সাফকবলা দলিল ইত্যাদি উচ্চারণ দম্ভ ও অজ্ঞতাপ্রসূত বলেই মনে হয়।

এটা সত্য যে সাংসদের দখল করা ৫৪ একরে তাঁরই মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিয়েছে। শুক্রবার প্রথম আলোয় ছাপা হয় যে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার (ইআইএ) বিষয়ে নদী রক্ষা কমিশনের বক্তব্যের সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর একমত নয়। অথচ শনিবার পুনঃ অনুসন্ধানে আরও নিশ্চিত হওয়া গেছে যে পরিবেশ অধিদপ্তরের অবস্থান অস্পষ্ট ও স্ববিরোধী। কারণ, ড্যাপের শর্ত অগ্রাহ্য করে তারা দাবি করছে, এলাকাটি ‘ইকোনমিক জোনে’ অবস্থিত, তাই পরিবেশগত ছাড়পত্রের দরকার নেই। এটা অসত্য ও বিভ্রান্তিকর।

তবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ কী করে ওই প্রকল্পে অনুমোদন দিল, সেটা তদন্তের দাবি রাখে। পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্ভট দাবি, তারা ইআইএ দিয়েছে, কারণ উদ্যোক্তা (সাংসদ) তাঁর দাখিল করা দলিল ও খতিয়ানে জমির শ্রেণি নদী, সেটা উল্লেখ করেননি। তাদের আরও হাস্যকর যুক্তি হলো তাদের পক্ষে জমির মালিকানা যাচাই সম্ভব হয় না। আবার নদীর ‘সীমানা পিলার না থাকায়’ তারা বুঝতে পারেনি। তার মানে তারা স্বীকার করল যে উল্লিখিত কারণে সাংসদের নদী দখলের বিষয়টি তাদের পরিদর্শকের ‘দুরবিনে’ সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়েনি। এরপর তারা যথারীতি ‘উন্নয়ন’ বুলির দোহাই দিয়ে বলেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারি ‘অগ্রাধিকার’ বিবেচনায় তারা পরিবেশগত ছাড়পত্র দিয়েছে।

এ সাফাই বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। বরং ভবিষ্যতে এ ধরনের রহস্যজনক ছাড়পত্রের পুনরাবৃত্তি বন্ধে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দরকার। নদী রক্ষা কমিশনের বক্তব্যের সঙ্গে ‘একমত নই’—পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের এ বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। তাঁদের উচিত দুঃখ প্রকাশ করে অবিলম্বে ছাড়পত্র বাতিল করা।

তর্কের খাতিরে আমরা বলব, যদি প্রমাণও হয় যে প্রকল্প এলাকার জমির পুরোটা বা কিছু অংশ আসলামুল হকের ‘বৈধ’ জমি, তাহলেও তিনি ড্যাপে প্লাবনভূমি ও জলাশয় বলে চিহ্নিত এলাকায় কোনো উন্নয়ন প্রকল্প করার অধিকার রাখেন না।

আসলামুল হক এ ব্যাপারে আদালতে মামলা চলার ওপর বেশি জোর দিলেও তিনি সংবাদ সম্মেলনে নিজের পক্ষেই ‘রায়’ দিলেন। আমরা আশা করব, এ বিষয়ে আদালতে কোনো বিচারাধীন মামলা থাকলে সেটা উচ্চ আদালতের নদী রক্ষামূলক মাইলফলক রায় ও সিদ্ধান্তের আলোকে এর দ্রুত শুনানি হবে। এটা সন্তোষজনক যে এই প্রথম এ রকম একটি বিষয়ে রাজউকসহ সরকারের অধিকাংশ বিভাগ নদী রক্ষার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। তাদের সবার প্রচেষ্টার জয় হোক।