রাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) যে ন্যূনতম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই, সেটা আবারও প্রমাণিত হলো। গত সোমবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আয়োজিত শুনানিতে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি সংস্থাটি, তাদের দেওয়া তথ্য-উপাত্তেও প্রচুর গরমিল আছে। শুনানির শুরুতে পেট্রোবাংলা প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) গ্যাসের দাম ১৫ টাকা ৩০ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি বলেছে, পেট্রোবাংলার খরচ হয় ১২ টাকা ৪৭ পয়সা। এর আগে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সময় দিনে গড়ে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানির হিসাব করা হয়েছিল। প্রকৃত অর্থে পেট্রোবাংলা দিনে ২৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম আমদানি করেছে। এতে আড়াই হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় করেছে পেট্রোবাংলা।
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির আদেশে (২০১৯ সালে) পাইকারি দর প্রতি ঘনমিটার ১২ দশমিক ৬০ টাকা করা হয়। এর মধ্যে ইউনিটপ্রতি ভর্তুকি দিয়ে ৯ দশমিক ৩৭ টাকায় বিক্রির নির্দেশ দেয় বিইআরসি। ২০২০ সালে প্রতি ইউনিটে পেট্রোবাংলার খরচ ১২ টাকা ৬০ পয়সা ধরে একবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। গ্রাহকের কাছ থেকে গড়ে ৯ টাকা ৩৬ পয়সা নেওয়া হলেও বাকিটা জ্বালানি সুরক্ষা তহবিল ও সরকারি কোষাগার থেকে ভর্তুকি হিসেবে পেট্রোবাংলাকে দেওয়া হয়।
ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম গ্যাসের বর্তমান দাম বহাল রেখে বিভিন্ন কর হ্রাস ও অপচয় বন্ধ করে পেট্রোবাংলার ঘাটতি কমানোর তাগিদ দিয়েছেন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমামও মনে করেন, দেশে প্রচুর গ্যাস মজুত থাকা সত্ত্বেও সংস্থাটি সেই গ্যাস উত্তোলনে না গিয়ে বিদেশ থেকে বেশি দামে এলএনজি আমদানি করছে। এতে জ্বালানি খাত যেমন পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, তেমনি ভোক্তাকে বেশি দাম দিতে হচ্ছে।
বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়ায় মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। কমিশন চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে, অযৌক্তিক কিছু চাপিয়ে দেবে না। তিনি পেট্রোবাংলাকে পরিচ্ছন্ন তথ্য-উত্থাপন করারও পরামর্শ দেন। বিইআরসির চেয়ারম্যানের সতর্কবাণীর পরও যে পেট্রোবাংলা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করবে না, তার নিশ্চয়তা কী। যেখানে অন্যান্য দেশে ২ শতাংশ সিস্টেম লস দেখানো হয়, সেখানে পেট্রোবাংলা দেখাচ্ছে ৮ শতাংশ। গ্যাসের অবৈধ সংযোগও বন্ধ করা হয়নি। গণমাধ্যমে খবর এলে কর্তৃপক্ষ লোকদেখানো অভিযান চালায়। অন্যদিকে প্রিপেইড মিটার সরবরাহের উদ্যোগও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এসব ক্ষেত্রে ট্রান্সমিশন কোম্পানিগুলোর কোনো আগ্রহ আছে নেই। তারা গ্রাহকের পকেট কাটতেই বেশি ব্যস্ত।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। রোজায় ভোগ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ওপর গ্যাসের দাম বাড়লে তা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। অতএব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে, এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়ানোর চিন্তা বাদ দিন। একই যুক্তি পানি ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও।
এসব সেবাপণ্যের দাম বাড়িয়ে সরকার যে বাড়তি রাজস্ব আয় করবে, সিস্টেম লসের নামে চুরি-অপচয় বন্ধ করতে পারলে তার চেয়ে বেশি সাশ্রয় হবে।