করোনা মহামারিতে সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম থমকে আছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কিন্তু দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা দিনাজপুরের এক উপজেলা হাকিমপুরে দেখা গেল ভিন্ন এক চিত্র। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিন্ন এক উপায়ে পাঠদানে শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত রেখেছেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকেরা। ছোট্ট একটি মেমোরি কার্ডের ভেতরে সম্পূর্ণ পাঠদান পেয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তাদের পাঠোন্নতিও পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে নিয়মিত। ফলে স্কুল বন্ধ থাকলেও থেমে নেই পড়াশোনা। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাসুদুল হাসানের কৌশলী ও উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ড এ সুযোগ তৈরি করেছে।
হাকিমপুর উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৬টি। মাসুদুল হাসানের দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে সব কটি স্কুলেই যুক্ত হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। আছে ইন্টারনেট সংযোগও। ক্লাসরুমগুলোর দেয়াল ভরিয়ে তোলা হয়েছে নানা আঁকিবুঁকি ও দৃষ্টিনন্দন নকশাতে। কিন্তু সেই ক্লাসরুমগুলোতে এখন নেই শিক্ষার্থীদের কোলাহল। করোনার কারণে প্রায় ১৫ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে আছে। শহরাঞ্চলের কিছু শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাসের সুযোগ পেলেও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের তেমন সুবিধা সে অর্থে নেই। ফলে দরিদ্র পরিবারের অনেক শিশুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে অনেক পরিবারের শিশু কাজে যুক্ত হয়ে পড়ছে।
এমন পরিস্থিতিতে কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবা শুরু করেন মাসুদুল হাসান। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসকেই বানিয়ে ফেললেন স্টুডিও। সেখানে অডিও-ভিডিওতে রেকর্ড করা পাঠদান মেমোরি কার্ডে নিয়ে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি ছুটে যান শিক্ষকেরা। মুঠোফোনে সেই কার্ড ঢুকিয়ে পাঠ নেয় শিক্ষার্থীরা। কম দামি মুঠোফোনেও সেই মেমোরি কার্ড কাজ করে। ফলে যাদের স্মার্টফোন নেই, তারাও এ সুবিধার আওতায় এসেছে। শিক্ষকেরাই পালা করে ফোনে শিক্ষার্থীর পড়াশোনার খবর রাখেন। শিক্ষার্থীদের বাড়ি গিয়ে বাড়ির পড়া (হোমওয়ার্ক) দেন। পরের সপ্তাহে সেগুলো আদায় করেন। একইভাবে করোনাকালীন শিশুর যত্ন, করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে মোটিভেশনাল ভিডিও তৈরি করেও অভিভাবকদের কাছে পৌঁছানো হয়।
মাসুদুল হাসানের দাবি, এর মাধ্যমে উপজেলার ৯৫-৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উপকৃত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষকেরা যেভাবে পাঠোন্নতির রেকর্ড সংরক্ষণ করছেন, তাতে শিক্ষার্থীদের পরের ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া সহজ হবে। সম্প্রতি এ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘দেশসেরা উদ্ভাবক-২০২১’-এর মর্যাদা দিয়েছে তাঁকে।
মাসুদুল হাসানের এ উদ্যোগ ও উদ্ভাবিত মডেল সারা দেশের জন্য আশার আলো হতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষা রংপুরের বিভাগীয় উপপরিচালক মুজাহিদুল ইসলামও প্রথম আলোকে তেমনটি বলেছেন, ‘ইতিমধ্যে হাকিমপুর উপজেলাকে মডেল ধরে প্রতিটি উপজেলায় তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে।’ আমরা আশা করব করোনার সময়ে শিক্ষা নিয়ে যে অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে দ্রুত এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাসুদুল হাসানের প্রতি আমাদের অভিনন্দন।