কারখানা খোলার ঘোষণা

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ২৩ জুলাই সকাল ছয়টা থেকে শুরু হওয়া কঠোর বিধিনিষেধ ৫ আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি অফিস, কারখানা, গণপরিবহনসহ সবকিছু বন্ধ থাকবে। বিধিনিষেধের আগে মানুষ যে যেখানে ছিল, সেখানে থাকবে। কিন্তু ৩০ জুলাই হঠাৎ করেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ঘোষণা এল ১ আগস্ট রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খোলা হবে।

এ ঘোষণায় সংশ্লিষ্ট খাতের শ্রমিকেরা যে ভীষণ দুর্ভোগে পড়েছেন। এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ থাকেন গ্রামে, কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে। মাত্র এক দিনের ব্যবধানে তাঁদের কর্মস্থলে যেতে বলা নিষ্ঠুরতাই বটে। শনিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা–ও গ্রহণযোগ্য নয়। কারখানার আশপাশের শ্রমিকদের দিয়েই যদি ১ আগস্ট কারখানা খোলা হবে বলে মালিকেরা কথা দিয়ে থাকেন, সরকার তা সবাইকে জানিয়ে দিল না কেন? সরকারি ঘোষণার পর থেকেই শ্রমিকেরা যে যেভাবে পারে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। পরিবহনের দাবিতে তঁারা রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভও করেছেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা রিকশা, ভ্যান, থ্রি–হুইলার, অটোরিকশা; ক্ষেত্রবিশেষে ট্রাক-মিনিট্রাকেও আসতে বাধ্য হয়েছেন। এ জন্য তাঁদের গুনতে হয়েছে ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি ভাড়া।

সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের শ্রমিকেরা, যাঁদের ফেরি পার হয়ে গন্তব্যে আসতে হয়েছে। পত্রিকা ও টেলিভিশনের ছবিতে দেখা যায়, অসম্ভব গাদাগাদি করে শ্রমিকেরা ফেরি পার হচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্যই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। অথচ এ অবস্থায় যে কারও পক্ষে যে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব নয়, তা নিশ্চয়ই নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়।

সরকারের এ আধা কঠোর ও পুরোপুরি শিথিল বিধিনিষেধ আরোপের কোনো যুক্তি আছে বলে মনে হয় না। এতে সংক্রমণ কমবে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ১৪ জুলাই ১৪ দিনের বিধিনিষেধ শেষ হওয়ার পর আরও দুই সপ্তাহের জন্য বিধিনিষেধ দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। সরকার সেই পরামর্শে কান না দিয়ে ঈদুল আজহার আগে সবকিছু আট দিনের জন্য খুলে দিল।

সরকার যদি ১ আগস্ট কারখানা খুলেই দেবে, তাহলে সেই ঘোষণা আগে দিতে পারত। ২৭ জুলাই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পরও নীতিনির্ধারকেরা জানিয়েছিলেন কারখানা বন্ধ থাকবে। তিন দিনের মাথায় খোলার ঘোষণা এল। আগেভাগে কারখানা খোলার ঘোষণা এলে শ্রমিকেরা অন্তত প্রস্তুতি নিতে পারতেন। যাত্রাপথে মানুষের ভিড় ও দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমত।

এ ক্ষেত্রে কারখানার মালিকদেরও দায় আছে। তাঁরা ‘ক্রয়াদেশ’ রক্ষার জন্য যতটা উদ্‌গ্রীব, শ্রমিকদের সমস্যা-সংকটের বিষয়ে ততটাই নির্বিকার। মালিকেরা ক্রয়াদেশ রক্ষার জন্য কারখানা চালু রাখবেন, তাই বলে শ্রমিকদের সংক্রমণের ঝুঁকিতে ঠেলে দিতে পারেন না। এই যে হাজার হাজার শ্রমিক ফেরিতে, সড়কে গাদাগাদি করে কর্মস্থলে এলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ সংক্রমিত হলে সে দায় কে নেবে? যে সংক্রমণ এড়াতে এত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বয়ান, সেই স্বাস্থ্যবিধিভঙ্গের কাজ সরকার ও কারখানার মালিকেরাই বারবার করছেন। গত ঈদুল ফিতরের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছে।

সরকার ও মালিকপক্ষের অবিমৃশ্যকারিতার কারণে শ্রমিকেরা এভাবে দুর্ভোগে পড়বেন, তাঁদের জীবন বিপন্ন হবে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিধিনিষেধ চলাকালে মালিককে কারখানা চালু রাখতে হলে শ্রমিকদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে।