কীর্তির মধ্যেই বেঁচে থাকবেন তিনি

আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন সেই সময়ের মানুষ, যাঁদের হাত ধরে ভাষা আন্দোলন সৃজিত হয়েছে, যঁারা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং যাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। ৮৮ বছর বয়সে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মৃত্যুকে কোনোভাবে অকালপ্রয়াণ বলা যাবে না। তবে তাঁর মৃত্যু যে শূন্যতা তৈরি করেছে, তা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি কেবল রাজনীতির মানুষ ছিলেন না। রাজনীতির বাইরে লেখালেখি, সংস্কৃতিচর্চা ও পরিবেশ আন্দোলনেও উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন মানুষটি।

আবুল মাল আবদুল মুহিতের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি, সিলেটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েও বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার ছিলেন। তিনিই সেই সরকারি কর্মকর্তা, যিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন চাকরি হারানোর ঝুঁকি সত্ত্বেও। একাত্তরে আমরা তাঁকে পাই একজন দেশপ্রেমিক কূটনীতিকের ভূমিকায়; যিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর সরকারি প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে আসীন থাকা ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ফোর্ড ফাউন্ডেশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।

পরবর্তীকালে মুহিত বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, সিলেট-১ আসন থেকে দুবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বড় সাফল্য হলো তাঁর আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার কয়েক গুণ বেড়েছে। তঁার আমলে উল্লেখযোগ্য হারে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বেড়েছে, অর্থনীতির ভিত সুদৃঢ় হয়েছে। আবার ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা কমাতে না পারা, শেয়ারবাজারে ধস থামাতে না পারা নিয়ে তাঁর আক্ষেপও ছিল।

আবুল মাল আবদুল মুহিতের জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। মন্ত্রিত্ব, সরকারি-বেসরকারি পদের বাইরেও তিনি সামাজিক দায়বোধ থেকে অনেক কিছু করেছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। যেখানেই থাকুন না কেন, আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিজেকে সদা যুক্ত রেখেছেন। শেষ জীবনে তিনি রাজনীতির মানুষ হয়েও দলীয় সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দিতেন না।

আবুল মাল আবদুল মুহিতের বিদায় আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনার, শোকের। প্রথম আলোর সঙ্গে তাঁর নৈকট্য ছিল নিবিড় ও গভীর। তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। বর্ণিল জীবনের অধিকারী এই মানুষ আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কীর্তিতে, তঁার সাধনায়।