ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার

গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে প্রায় ৯ মাস ধরে আটক লেখক মুশতাক আহমেদ বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেছেন—এই খবর প্রচারিত হওয়ার পর সমাজে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবাদ সমাবেশ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাগরিকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, এই মৃত্যুর দায় কার?

গত বছরের ৬ মে র‌্যাবের সদস্যরা লেখক মুশতাক আহমেদকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তা ও গুজব’ ছড়ানোর অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেছিল র‌্যাব। একই মামলার আসামি করা হয়েছে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও রাষ্ট্রচিন্তা নামের সংগঠনের সদস্য দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়াসহ ১১ জনকে। দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া জামিনে মুক্তি পেয়েছেন, কিন্তু মুশতাক ও কিশোরের জামিনের আবেদন আদালতে নাকচ হয়েছে ছয়বার। সর্বশেষ ২৩ ফেব্রুয়ারি মামলাটির শুনানির জন্য এই দুজনকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। মুশতাকের পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য, তাঁরা সেদিন তাঁকে সুস্থ অবস্থায় দেখতে পেয়েছেন। তাহলে ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কীভাবে তাঁর মৃত্যু হলো?

কারারুদ্ধ লেখক মুশতাক আহমেদ যে রাতে মারা গেলেন, সেদিনই প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়্গ’ শিরোনামের সম্পাদকীয় নিবন্ধ। এই আইনের খড়্গটি যে আক্ষরিক অর্থেই ৫৩ বছর বয়সী একজন মানুষের প্রাণ সংহার করবে, এমন আশঙ্কা আমাদের ছিল না। মানুষটি লেখক ছিলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের মতপ্রকাশে সক্রিয় ছিলেন। ডিজিটাল মাধ্যমে স্বাধীন চিন্তা ও মতামত প্রকাশের সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের যে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে, তা এ রকম অনেক মানুষের নিপীড়ন–নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এটা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু জামিনে মুক্তির সুযোগ থেকে বারবার বঞ্চিত হয়ে কারাগারের মধ্যে কেউ ‘জীবন থেকেই মুক্তি’ পাবেন—এমন মর্মান্তিক সংশয় আমাদের ছিল না।

মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলো অনলাইনে লিখেছেন, ‘এই মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। মতপ্রকাশের কারণে একজন লেখককে এভাবে দিনের পর দিন আটকে রাখা এবং একপর্যায়ে তাঁর মৃত্যুর দায় রাষ্ট্র, সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।’ এই বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশের যুক্তি নেই। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করছেন নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে, কিন্তু দোহাই দিচ্ছেন ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ বা রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা, গুজব ইত্যাদির। আইনটির অপব্যবহার করতে গিয়ে আইন প্রয়োগের যথাযথ প্রক্রিয়াও অনুসরণ করা হচ্ছে না। অভিযোগপত্র তৈরির ক্ষেত্রে অসৎ পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে, মিথ্যা সাক্ষ্য সাজানো হচ্ছে; নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র পেশ না করে তদন্তের সময়সীমা বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে; কোনো কোনো মামলায় আদালতের কাছে সময় বাড়ানোর আবেদনই করা হচ্ছে না, নিজেদের খেয়ালখুশিমতো কাজ করা হচ্ছে। এভাবে নাগরিকদের চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সরকারি কর্মকাণ্ডের সমালোচনার পথ রুদ্ধ করতে গিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের কিছু মৌল নীতি লঙ্ঘন করা হচ্ছে; গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের গুরুতর ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে।

লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনের জন্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তদন্তের ফল তাঁর পরিবারসহ দেশবাসীর জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করা উচিত। একই মামলায় কারারুদ্ধ এবং অসুস্থ কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে মুক্তি দেওয়া হোক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের শিকার হিসেবে আরও যেসব ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে, তাঁদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হোক। আর আমরা আবারও বলি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের আইনটি বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন-বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হোক।