পাহাড়ি ঢলে সিলেটে এই মৌসুমে জলাবদ্ধতা নতুন কিছু নয় বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। কিন্তু যে কথাটি তিনি বলেননি, তা হলো তাঁর শৈশবের সিলেটের সঙ্গে এখনকার সিলেটের তফাত আকাশ–পাতাল। শৈশবে শহরে পানি ঢুকলে অনায়াসে সরে যেত, যাওয়ার খাল-নালা ইত্যাদি ছিল। কিন্তু এখনে সেই অবস্থা নেই। মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, শহরের পুকুর ও দিঘিগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা বেড়েছে।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গত পাঁচ দশকেও সিলেটের প্রধান নদী সুরমা খনন করা হয়নি। ফলে তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে শতাধিক স্থানে ছোট ছোট চর জাগে। ফলে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে সয়লাব হয়ে যায় নদীর দুই পাড়।
বছরের পর বছর চলে যায়। কিন্তু শহরের খাল-নালাগুলো সচল রাখার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। একদিকে খাল কাটা, অন্যদিকে ভরাট হতে থাকলে শহরের জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। গত ১২ বছরে খাল উদ্ধারের নামে ৮৬৯ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। অথচ সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। তাহলে সমস্যাটা কোথায়, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এই সমস্যা কেবল সিলেটের নয়, দেশের ছোট-বড় প্রায় সব শহরেরই। চলতি বছর সিলেট এলাকায় এটি দ্বিতীয় দফা বন্যা। প্রথম দফায় সিলেটে খুব বেশি ক্ষতি না হলেও সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যায়।
কৃষকেরা আধা পাকা ধান কাটতে বাধ্য হন। সেই ক্ষতি পুষিয়ে না উঠতেই দ্বিতীয় দফা বন্যায় বিভাগীয় শহরসহ সিলেটের ১৩টি উপজেলা, সুনামগঞ্জের ৬টি উপজেলা প্লাবিত হয়। এই সম্পাদকীয় লেখা পর্যন্ত সুনামগঞ্জে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
উজানে বৃষ্টিপাত বন্ধ হওয়ার পরও ভাটিতে পানি কমতে দু-তিন দিন সময় লাগবে। সে ক্ষেত্রে কবে নাগাদ সিলেট ও সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষগুলো রেহাই পাবে, বলা কঠিন। ইতিমধ্যে সিলেটে ২৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেসব কেন্দ্রে মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুও আশ্রয় নিয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বুধবার নগরের চালিবন্দর এলাকার কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তাঁদের উপস্থিতিতেই আশ্রয়প্রার্থীরা ত্রাণসামগ্রী অপ্রতুল বলে অভিযোগ করেছেন। মানুষ ঘরে বা আশ্রয়শিবির—যেখানেই থাকুন, তাঁদের খাইয়ে বাঁচাতে হবে। দেখতে হবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পানিবাহিত বা অন্য কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব যেন না ঘটে।
আমাদের মন্ত্রীদের তখনই বাজার স্থিতিশীলতার কথা মনে পড়ে, যখন পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়; জলাবদ্ধতার কথাও তাঁদের তখন মনে পড়ে, যখন বন্যায় সবকিছু ডুবে যায়। কিছুদিন পর তাঁরা সেই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলেও যান। এ রকম ভুলোমন মন্ত্রীদের দিয়ে আর যা–ই হোক, জনজীবনের দুর্গতি-দুর্ভোগ কমানো যাবে না। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। তাঁরা এসবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে অভ্যস্ত।
কিন্তু মানবসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে কীভাবে আমরা উদ্ধার পাব? প্রতিবছরই উজানের ঢলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যায়; যার ওপর হয়তো আমাদের তেমন হাত নেই। কিন্তু আমরা খাল-পুকুরগুলো উদ্ধার করে, নদীর নাব্যতা বাড়িয়ে বন্যার প্রকোপ ও মানুষের দুর্গতি কমাতে পারি। কিন্তু সরকারের সেই প্রস্তুতি আছে বলে মনে হয় না।