প্রলম্বিত বিধিনিষেধ

করোনার সংক্রমণ রোধে ১ জুলাই জারি করা কঠোর বিধিনিষেধের মেয়াদ সরকার আরও এক সপ্তাহ বাড়িয়েছে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ১৪ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত লকডাউন জারি থাকবে। এর চার দিন পর পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি না হলে ঈদের ছুটি পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পুরো দেশ এই বিধিনিষেধ বা লকডাউনের আওতায় থাকবে।

লকডাউনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি এবং জীবনযাত্রায় যে ছন্দপতন হয়েছে, তা–ও মানুষ মেনে নিয়েছে। তারা ধরে নিয়েছে, করোনা থেকে মুক্তি পেতে এর বিকল্প নেই। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনের কারণে যেসব স্বল্প আয়ের, তথা দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের জীবিকা বন্ধ হয়ে গেছে, তা থেকে উত্তরণের উপায় কী? সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী করোনার আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার তাদের নানাভাবে সহায়তাও দিচ্ছে, যদিও স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে অনেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

করোনার কারণে কাজ হারিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা হারিয়ে নতুন করে যে দুই–আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছেন, তাঁদের সহায়তায় সরকার সে রকম কোনো পরিকল্পনাই নেয়নি। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত গরিব মানুষের জন্য উল্লেখযোগ্য সহায়তা হলো ৩৬ লাখ লোককে দুই দফায় আড়াই হাজার টাকা করে অনুদান। লকডাউনের কারণে লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, যাঁদের অন্যান্য চাহিদা মেটানো দূরের কথা, দুমুঠো খাবার জোগাড় করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশনে এই হতদরিদ্র মানুষের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রায় প্রতিদিনই লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব মানুষকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ লকডাউনের এক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরও তাঁরা তেমন সহায়তা পাননি। সরকার ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে হটলাইনে সহায়তা চাওয়ার কথা বলেছে। এতে কিছু পরিবার উপকৃত হলেও সহায়তার বাইরেই থেকে গেছেন সিংহভাগ মানুষ। অনেকে এই সহায়তার খবরও জানেন না। সরকারের উচিত ছিল লকডাউন ঘোষণার আগে খানা জরিপ করে প্রতিটি এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ও নিরুপায় মানুষের ঘরে খাবার বা নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়া।

লকডাউনে গরিব মানুষগুলো আছেন উভয়সংকটে। ঘর থেকে বের হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের আটক ও জরিমানা করে। আর ঘরে বসে থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লকডাউন কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে, তা নিয়ে নিশ্চয়ই কিছু বলার নেই। কিন্তু আয়রোজগারের জন্য যাঁরা মাঠে নামতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের কী হবে? বিধিনিষেধ কার্যকর করার পাশাপাশি বিষয়টি অবশ্যই সরকারের বিবেচনায় থাকতে হবে। গত বছর কঠোর বিধিনিষেধের সময় সরকারি, এমনকি বেসরকারি পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ থাকলেও দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য এবার তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

আগামী ঈদ পর্যন্ত বিধিনিষেধ অব্যাহত থাকলে পরিবহনশ্রমিক, দোকান কর্মচারী, দিনমজুর বা নির্মাণশ্রমিকসহ আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া বিভিন্ন খাতের অসংখ্য মানুষের খাবারের সংস্থান কীভাবে হবে, তার একটি পরিকল্পনা করে সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত সব মানুষকে সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজনও হয় না। অনেকে নিজে থেকেই বিকল্প পথ খুঁজে নেন কিংবা আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় কোনোরকমে দিন পার করেন। কিন্তু যাঁরা একেবারে নিরুপায়, তাঁদের ঘরে খাবার বা নগদ টাকা পৌঁছাতেই হবে। একই সঙ্গে সমাজের বিত্তবান মানুষদের প্রতিও আশপাশের বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করার আহ্বান জানাই।