বন্যা পরিস্থিতি

দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে সপ্তাহ দুই আগেই বন্যা শুরু হয়েছে। আষাঢ়ের শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। শ্রাবণ মাস শুরু হওয়ার আগেই বৃষ্টিপাত বাড়তে আরম্ভ করেছে, বৃষ্টির পানির সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর পানি বেড়েছে এবং আরও বাড়ছে। বিশেষভাবে দ্রুতগতিতে বাড়ছে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি।

বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ। রোববার দুপুর পর্যন্ত ওই জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বিপৎসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়া তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারসহ ওই জেলার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৬টি নদ–নদীর প্রতিটিতেই পানি বেড়ে চলেছে বলে আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান। ইতিমধ্যে জেলার ৭২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫৩টির প্রতিটিই প্লাবিত হয়েছে; ঘরবাড়ি জলমগ্ন হয়েছে ৫২ হাজার ৫২০টি পরিবারে, যাদের মোট সদস্যসংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। এটা সরকারি হিসাব। বেসরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে, অন্তত ৪ লাখ পরিবার ইতিমধ্যে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সরকারি হিসাবেই ১ হাজার ৩১টি পরিবার বন্যাজনিত নদীভাঙনের ফলে গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ৭৭টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, সেগুলোতে এ পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছে ৩ হাজার ৮০০ গৃহহীন মানুষ।

আমাদের লালমনিরহাট প্রতিনিধি রোববার দুপুরে স্থানীয় সরকারি সূত্রের বরাতে জানিয়েছেন, ওই জেলার ৪৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ২০টি ইতিমধ্যে বন্যাপ্লাবিত হয়েছে; ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৬ হাজার ৮৫০। ১২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং সেগুলোতে এ পর্যন্ত ৮৫০ জন দুর্গত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের ভাটির দিকের জেলা রংপুরের কিছু এলাকায়ও বন্যা দেখা দিয়েছে। উজান থেকে আসা পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে রংপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নেওয়ার আশঙ্কার খবর স্থানীয় লোকজনের সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে। ওই জেলার মানুষেরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছে, বড় বন্যা তাদের দিকে ধেয়ে আসছে।

বগুড়া জেলার পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৫১ সেন্টিমিটার বেড়ে শনিবার বেলা তিনটায় বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় ইতিমধ্যে বন্যা দেখা দিয়েছে। এসব উপজেলার অনেক গ্রামের ফসলের খেত, মানুষের ঘরবাড়ি, বিদ্যালয় ইত্যাদি প্লাবিত হয়েছে। অনেক দুর্গম চর ইতিমধ্যে জলমগ্ন হয়েছে। আউশ ধান, পাট ইত্যাদি ফসল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেক কৃষক আরও ক্ষতি এড়াতে পাট কেটে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। বগুড়ার পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে বলা হয়েছে, যমুনা নদীর পানি বগুড়া অঞ্চলে আগামী সপ্তাহে আরও বাড়বে।

উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি গুরুতর রূপ নিতে যাচ্ছে এবং ওই সব অঞ্চল থেকে পানি নেমে যাওয়ার সময় দেশের মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের অনেক এলাকায়ও বড় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। ওদিকে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষও বন্যায় দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতেও অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে গুরুতর বন্যা দেখা দিয়েছে।

কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে যেসব ত্রাণ তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, তা নির্মমভাবে অপ্রতুল। বন্যাকবলিত পরিবারগুলোকে জেনারেল রিলিফ ফান্ডের (জিআর) চাল, বিস্কুটজাতীয় শুকনো খাবার ও নগদ টাকা দেওয়া হচ্ছে বটে, কিন্তু তার পরিমাণ অতিনগণ্য। যেমন, কুড়িগ্রাম জেলার সাড়ে ৫২ হাজার বন্যাদুর্গত পরিবারের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ৬ লাখ ৭৫ টাকা। লালমনিরহাট জেলার জন্য বরাদ্দ মাত্র আড়াই লাখ টাকা, ১৫০ মেট্রিক টন চাল আর ১ হাজার ৪০৩ কার্টন শুকনো খাবার।

ত্রাণ বরাদ্দ ও তা সুষ্ঠুভাবে বিতরণের তৎপরতা ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে এবং অচিরেই বড় বন্যার বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে।