বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তদন্ত কমিটি হোক

সম্পাদকীয়

স্বল্প সময়ের ব্যবধানে গাজীপুরের শ্রীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে ১১টি জেব্রা, একটি বাঘ ও একটি সিংহীর মৃত্যুর ঘটনা কেবল অস্বাভাবিক নয়, নজিরবিহীনও। প্রাণীগুলোর মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তার সই করা বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনার পূর্বাপর ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়নি।

জানুয়ারি মাসে কয়েক দফায় ১১টি জেব্রার মৃত্যু হয়েছে পার্কটিতে। একই মাসে মারা যাওয়া বাঘের শরীরে পাওয়া গেছে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সাফারি পার্কে সর্বশেষ একটি সিংহের মৃত্যু হয়েছিল। তখন কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, পার্কটিতে আর ১০টি সিংহ অবশিষ্ট থাকল। সে হিসাবে সিংহীর মৃত্যুর পর এখন অবশিষ্ট রইল ৯টি।

সাফারি পার্কের প্রাণীরা কী অবস্থায় আছে, সে-সম্পর্কিত তথ্য নিয়েও লুকোচুরি করছেন পার্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। সাফারি পার্কে বাঘের মৃত্যুর পর সে খবর দীর্ঘদিন গোপন রাখা হয়েছিল। জানুয়ারি মাসে পার্কটিতে কয়েক দফায় মারা যায় ১১টি জেব্রা। একই মাসে মারা যাওয়া বাঘের শরীরে পাওয়া গেছে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু। একের পর এক প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনায় এ পর্যন্ত দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে পার্কটির প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদুল কবির, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান ও সেখানকার বন্য প্রাণী চিকিৎসা কর্মকর্তা হাতেম জুলকারনাইনকে।

প্রথমত, বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে হবে এত স্বল্প সময়ে এতগুলো প্রাণী কেন মারা গেল? এসব প্রাণীর শরীরে কি কোনো ভাইরাস ঢুকেছিল? সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসকেরা কি আক্রান্ত প্রাণীদের চিকিৎসা করতে যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন? যদি কারও গাফিলতিতে প্রাণীগুলো মারা গিয়ে থাকে, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। আর যদি তাঁদের কোনো অবহেলা না থাকে, সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন আসবে।

সাফারি পার্কের এতগুলো প্রাণীর মৃত্যুর বিষয়টি হেলাফেলাভাবে দেখা উচিত নয়। আমাদের চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কগুলোতে বহু বছর ধরেই অযত্ন ও অবহেলা লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রথমত, এসব স্থানে প্রয়োজনীয় জনবল নেই। যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রশাসনের অন্যান্য স্থানের মতো এখানেও রাজনৈতিক ও দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় নিয়োগ হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। সাফারি পার্কের পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে স্থানীয় সাংসদ ইকবাল হোসেনও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

কিন্তু সেই ব্যবস্থা নেওয়ায় আগে প্রাণীগুলোর মৃত্যুর সঠিক কারণ চিহ্নিত করতে হবে। পরিবেশ, বন্য ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় একজন আমলার নেতৃত্বে যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, তাতে সত্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। একই বিভাগের কর্মকর্তা বা আমলা দিয়ে তদন্ত কমটি হলে তাঁরা পার্কের কর্মকর্তাদের রক্ষা করতে চাইবেন।

দ্বিতীয়ত, এতগুলো প্রাণী মারা যাওয়ার পরও সাফারি পার্কটি দর্শনার্থীদের জন্য খোলা রাখা কতটা সমীচীন হয়েছে, তা-ও ভেবে দেখার বিষয়। করোনার সংক্রমণ এখনো ঊর্ধ্বগামী। সে ক্ষেত্রে কিছুদিনের জন্য হলেও সাফারি পার্কটি বন্ধ রাখা হোক। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হোক। এরপর তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে সিদ্ধান্ত হবে পার্কটি খোলা থাকবে না বন্ধ থাকবে। সাফারি পার্কের নামে আমরা এতগুলো প্রাণীকে হত্যা করতে পারি না। প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা কেবল বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কেই ঘটেনি, ঘটেছে রংপুর চিড়িয়াখানায়ও। অতএব কর্তৃপক্ষকে গতানুগতিকভাবে সবকিছু দেখলে চলবে না।