প্রথম দুই দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক হাঙ্গামা ও প্রাণহানির পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে আশা করেছিলেন, তৃতীয় দফার ভোটটি অন্তত মোটামুটি সুষ্ঠু হবে। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনও এমন হাবভাব করেছিল যে এবার দেখিয়ে দেবে। দিন শেষে তারা যা উপহার দিল, তাকে নির্বাচন না বলে নির্বাচনী প্রহসন বলাই শ্রেয়। আর এ প্রহসনে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানি ও দেড় শতাধিক আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে বিজিবির একজন সদস্যও আছেন। কমিশন এখন কী বলবে?
অন্যান্য দেশে নির্বাচন কমিশন আগের নির্বাচনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের নির্বাচনে তা সংশোধনের চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের এখানে সার্চ কমিটি অনেক ঝাড়াই-মোছাই করে যে কমিশন গঠন করেছে, তারা কখনোই ভুল করে না। ফলে সংশোধনেরও প্রয়োজন হয় না। তৃতীয় দফার নির্বাচনের ভোট গ্রহণ পর্ব শেষ না হতেই ইসির সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেছিলেন, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও এবার মডেল নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল, নির্বাচনী কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা থেকে শুরু করে সব ধরনের অঘটনই ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পরিস্থিতি সামাল দিতে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছে। নির্বাচনী যুদ্ধটা সরকারি ও বিরোধী দলের প্রার্থীদের মধ্যে হলে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর পক্ষ নিতে সুবিধা হতো; যদিও সব ক্ষেত্রে তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকাই নেওয়ার কথা। যুদ্ধটা যখন ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে, তখন পক্ষ নেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে পড়ে।
নির্বাচনে কে জয়ী হলেন, কে পরাজিত হলেন, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচনটি কেমন হলো। সামনে আরও কয়েক দফা নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই নির্বাচনও এর থেকে ভালো হবে, তার কোনো লক্ষণ নেই। স্থানীয় পর্যায়ের এ নির্বাচনে কি সংঘাত-সংঘর্ষ ঠেকানো যেত না? জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যেত না? নির্বাচন কমিশন ভোটার উপস্থিতির একটি তথ্য প্রকাশ করে, যার সঙ্গে অনেক সময় মাঠের চিত্রের মিল পাওয়া যায় না। গেল দুই দফার মতো তৃতীয় দফায়ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকে নির্বাচিত হয়েছেন।
এ বিতর্কিত নির্বাচনেও জনগণ যেখানে সুযোগ পেয়েছে, জবাব দিয়ে দিয়েছে। শেরপুরে যে নৌকার প্রার্থী পাঁচ মিনিটে ভোট শেষ করার কথা বলেছিলেন, আট ঘণ্টা ভোট করে সেখানকার মানুষ তাঁকে হারিয়ে দিয়েছেন। বগুড়ায় আরেক নৌকার প্রার্থী বিএনপির সমর্থক প্রার্থীর সমর্থনে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। সেখানে যে বিদ্রোহী প্রার্থী সামান্য ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন, আওয়ামী লীগ থেকে তাঁকে আগেই বহিষ্কার করা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে এলাকাটি এখন ‘আওয়ামী লীগশূন্য’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে এ রকম আরও অনেক স্থানেই শূন্য ফল নিয়ে আওয়ামী লীগকে সন্তুষ্ট থাকতে হতো।
জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করবেন কে? দল কিংবা নির্বাচন কমিশন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে না। নির্বাচন করে জনগণ, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তাদের ভূমিকাই ছিল গৌণ। নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক না হওয়ায় তাঁরা স্বাধীনভাবে প্রতিনিধি বাছাই করতে পরেননি। তাঁদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি, তা হোক স্থানীয় কিংবা জাতীয় পর্যায়ে, ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও ভঙ্গুর করে তুলবে। নির্বাচন কমিশন যেহেতু এ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিল, এ ব্যর্থতার দায় তাদের নিতেই হবে।