বিশ্বায়নের যুগে আমাদের সমাজচিন্তায় নানা পরিবর্তন আসছে। জীবনযাত্রার মান বাড়ছে, ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। একটি নিশ্চিত ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের আশায় মানুষের প্রচেষ্টার শেষ নেই। নাগরিক জীবনে খাপ খাইয়ে নিতে কর্মব্যস্ততারও শেষ নেই। এর ফলে ঘুরেফিরে একটি বিষয় উঠে আসে—মানুষ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে; বিশেষ করে পরিবারের সঙ্গে বা অন্যান্য সদস্যের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। যার বড় ভুক্তভোগী হচ্ছেন বয়স্করা। একসময় প্রাণচাঞ্চল্যময় যৌথ পরিবার থেকে উঠে আসা এসব মানুষ পড়ে গেছেন এক সংকটে। প্রতিষ্ঠিত একাধিক সন্তান থাকলেও কার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবেন—এ দোটানায় ভুগতে থাকেন তঁারা। তারই একটি করুণ চিত্র আমরা পেলাম ঢাকার ধামরাই উপজেলায়। ৯৫ বছর বয়সী এক মায়ের ঠাঁই হয় না সন্তানদের কাছে। জীবনের শেষ বয়সে এসে কোনো মানুষের এমন পরিণতি আমাদের ভাবায়।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানায়, ধামরাই উপজেলার কুশুরা ইউনিয়নের নরসিংহপুরে গ্রামে স্থানীয় বাজার থেকে উদ্ধার করা হয় ৯৫ বছর বয়সী মরিয়ম বেগমকে। তাঁর ছয় ছেলে। সবাই প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের মধ্যে একজন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা, দুজন ব্যবসায়ী, একজন চিকিৎসক বিসিএস ক্যাডার। একজন দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। দুই মেয়ে থাকলেও তাঁরা আর্থিকভাবে সচ্ছল নন। ২০০০ সালে স্বামী আবদুস সালামের মৃত্যুর পর এক সন্তানের সঙ্গেই থাকতে শুরু করেন মরিয়ম। সেই সন্তানকে কিছু জায়গা–জমি লিখে দেওয়ায় অন্য সন্তানেরা রাগ করেন। এর পর থেকেই তাঁরা মায়ের দায়িত্ব নেওয়া প্রায় ছেড়েই দেন। সন্তানদের এমন অবহেলা কি কখনো কাম্য ছিল মরিয়ম বেগমের? তিনি বলছেন, ‘আমি কী করলাম! অনেক সম্পদ ছিল। পোলাহানরে আমি ভাত দেই নাই? এহন আমারে ভাত দেয় না। আমারে ভাত দিব না কেন?’
এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর মরিয়ম বেগমের দায়িত্ব নেন তিন ছেলে। দেরিতে হলেও শুভবুদ্ধি হওয়ায় ধন্যবাদ জানাই। সন্তানদের ঘরে আশ্রয় না পেয়ে মা-বাবা রাস্তায়—কিছুদিন আগেও এমন এক ঘটনা বেশ আলোচিত হয়েছিল। সন্তানেরা কেউ দায়িত্ব নিতে না চাইলে স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি সুরাহা করে। মহামারিতে আমরা আমাদের অনেক বয়স্কদের হারিয়েছি। করোনায় আক্রান্ত মা-বাবাদের বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন সন্তানেরা। আবার মাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়েছিল সন্তান, এ খবরও আমরা পাই। মহামারি–পরবর্তী বদলে গেছে গোটা দুনিয়া। সমাজ-পরিবারে নানা প্রভাব পড়েছে। সেখানে বয়স্কদের আরও বেশি যত্নবান ও আন্তরিক হওয়া দরকার। তাঁদের আগলে রাখার বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকাই কাম্য।