সম্পাদকীয়

বাংলাদেশে একের পর এক গড়ে উঠছে শিল্পাঞ্চল। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সেখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। কিন্তু সেসব সুযোগ-সুবিধা পেতে নানা হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ দাবি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে অনেকটা অসহায় পড়ছেন তাঁরা। দেশীয় বিনিয়োগকারীরা এ নিয়ে ভুগতে ভুগতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেও বিপাকে পড়েন বিদেশিরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে সুরাহা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত নিজ দেশের দূতাবাসের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে তঁাদের। বিষয়টি বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে নিঃসন্দেহে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মতো পরিষেবা পেতে মূলত বেশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে। সঠিক সময়ে লাইসেন্স পেতে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গড়িমসি করেন। টাকার লেনদেনের মাধ্যমে সেটি দফারফা করতে হয়। এ ছাড়া জমির নামজারি ও ব্যাংকঋণ পেতে দেরি হওয়ার পাশাপাশি বন্দরে শুল্ক নিয়ে জটিলতার মুখেও পড়তে হচ্ছে তাঁদের। এসব নিয়ে প্রতিদিন চার-পাঁচটি করে অভিযোগ জমা পড়ছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) বিনিয়োগ-উত্তর সেবা শাখায়। সেখান থেকেই আমরা জানতে পারছি, সরকারি দপ্তরগুলোর আন্তরিকতার অভাবের কারণে এসব অভিযোগ আসছে। বিডায় গিয়ে কেউ কেউ সমাধান পাচ্ছেন, কিন্তু অনেকেই প্রতিষ্ঠানটির এই শাখার কথা জানেন না। এ নিয়ে প্রচারণা কম বলে স্বীকার করেছে বিডা নিজেই। বিষয়টি হতাশাজনক।

দেশে দুর্নীতির দুষ্টচক্র নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে অনেক উন্নয়নমূলক প্রকল্প থেকে সুফল মিলছে না।
এই দুর্নীতির বড় শিকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক জরিপেও উঠে এসেছে, দেশে ব্যবসা করতে গিয়ে দুর্নীতিকেই প্রধান বাধা হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসার ক্ষেত্রে ১৬টি সমস্যার মধ্যে
দুর্নীতিকে এক নম্বরে রেখেছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও অর্থায়নের সীমিত সুযোগ হলো তৃতীয় সমস্যা। এর আগে ২০২০ সালেও ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে একটি জরিপ করেছিল সিপিডি। তখনো একই সমস্যা উঠে এসেছিল।

আগামী ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। তখন শুল্কমুক্তসহ অনেক সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। তাই এখন থেকেই বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছে সরকার। এদিকে বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশ আট ধাপ এগিয়েছে। এর মানে, এখানে ব্যবসার পরিবেশে উন্নতি হচ্ছে। এরই মধ্যে সরকার সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরসহ বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল এখন দৃশ্যমান। সেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পনগরে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা ও প্রতিশ্রুতির খবর প্রায়ই আমরা শুনে থাকি। কিন্তু সেখানে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহজে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার নিশ্চয়তা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রোধ করতেই হবে। ব্যবসা ব্যাহত হলে বা খরচ বেড়ে গেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশবিমুখ হবেন।

করোনাকালীন অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে মহামারির কারণে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব আমরা দেখেছি। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগবান্ধব বাংলাদেশ গড়ার কোনো বিকল্প নেই। সেটি শুধু মুখে বলা নয়, বাস্তবেও দেখাতে হবে।