সম্পাদকীয়

যখন কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতির প্রশংসা করে, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা জোরালো কণ্ঠে তা প্রচার করতে থাকেন। কিন্তু যখনই কোনো সংস্থা বা দেশ বাংলাদেশের নাগরিক অধিকার বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তখন তাঁরা এর মধ্যে ‘ষড়যন্ত্র’, ‘বিদ্বেষ’ ইত্যাদি আবিষ্কার করতে উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠেন। প্যারিসভিত্তিকে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (আরএসএফ) প্রকাশিত রিপোর্ট ২০২২-এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

আরএসএফের রিপোর্ট অনুযায়ী, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ এক বছরে ১০ ধাপ পিছিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২–তে অবস্থান করছে। গত বছর ছিল ১৫২। মানবাধিকার সূচকের মতো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকেও বাংলাদেশের ক্রমাবনমন ঘটছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থান আমাদের জন্য লজ্জাকর বলেই মনে করি। সূচকে বাংলাদেশের এই ক্রমাবনমনের কারণ প্রধানত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।

বাংলাদেশে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হরণের আরও অনেক আইন আছে। যেমন বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, তথ্যপ্রযুক্তি আইনও দণ্ডবিধির ৯৯-এ ধারা। অতীতে এসব আইনে অনেক সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন, জেল খেটেছেন। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ দেশের সাংবাদিক সমাজ তথা সাংবাদিকতাকে মহা আতঙ্কের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

বিশ্ব গণমাধ্যম দিবসে সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এই আইন গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে অন্তরায়। এ বছর বিশ্ব গণমাধ্যম দিবসের মূলমন্ত্রও হলো ‘ডিজিটাল অবরোধে সাংবাদিকতা’। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যতই বলুন না কেন, ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ দমন করতে এই আইন, বাস্তবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই বেশি মামলা হয়েছে এই আইনে। এই আইনের বেশ কিছু ধারা অজামিনযোগ্য। মামলা হলেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জেলে যেতে হয়। যেহেতু মামলার বাদী প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, তাই এর গতিও বেড়ে যায়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল থার্টি নাইনের হিসাবমতে, এ বছরের প্রথম তিন মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৩৮টি মামলা হয়েছে এবং এসব মামলার বিবাদীদের মধ্যে পাঁচজন সাংবাদিক।

২০২০ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর ৬৩১টি হামলা রেকর্ড করা হয়েছে, যেগুলোর ভিকটিমদের মধ্যে ২৬৫ জন ছিলেন সাংবাদিক। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম গত বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দ্বারা নিগৃহীত হন। তাঁর বিরুদ্ধে শত বছরের পুরোনো সরকারি গোপনীয়তা আইনে হয়রানিমূলক মামলা করা হয়। তাঁর হয়রানির বিরুদ্ধে সাংবাদিক সমাজ সোচ্চার প্রতিবাদ করলেও মামলাটি এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি।

এ অবস্থায় স্বাধীন সাংবাদিকতা কীভাবে সম্ভব? আমাদের সংবিধান সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিলেও পূর্বাপর সরকারগুলো স্বাধীন গণমাধ্যমের হাত–পা বেঁধে দিতে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে; যার সর্বশেষ হাতিয়ার হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ আরএসএফের রিপোর্টকে বিদ্বেষমূলক বলে অভিহিত করেছেন। সংস্থাটি সূচক নির্ধারণের পাশাপাশি বেশ কিছু তথ্য–উপাত্তও যুক্ত করেছে। মন্ত্রী সত্য অস্বীকার না করে যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অতি ও অপব্যবহার রোধ করার উদ্যোগ নিতেন, তাহলে সূচকের অবনমনের গ্লানি থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হতে পারে।