১১০০ কোটি টাকা লোকসানের দায় কার

গত পাঁচ বছরে মিসর থেকে ভাড়ায় আনা দুটি বোয়িং উড়োজাহাজের কারণে বাংলাদেশ বিমানের ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বিমান দুটি চালিয়ে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর ওগুলোর পেছনে খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ফলে পাঁচ বছরে ক্ষতি, লোকসান বা অপচয়—যা-ই বলা হোক, পরিমাণটা কিন্তু ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

খোদ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং এই মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে ক্ষতির বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে। এসব তদন্তে বলা হয়েছে, বিমানের স্বার্থের পরিপন্থী এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ইঞ্জিনের সক্ষমতা যাচাইয়ে ঘাটতি ছিল, কারিগরি কমিটি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেনি। তবে এ জন্য কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যায়নি।

২০১৪ সালে ওই দুটি উড়োজাহাজ ভাড়ায় এনেছিল বাংলাদেশ বিমান। এক বছরেই প্রথম উড়োজাহাজটির একটি ইঞ্জিন বিকল হয়। সেটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে আরেকটি ইঞ্জিন ভাড়ায় আনা হয়। দেড় বছরের মাথায় সেটিও নষ্ট হয়। ভাড়ায় আনা হয় আরও একটি ইঞ্জিন, সেটিও নষ্ট হয়েছে। কিন্তু প্রতি মাসে ইঞ্জিনের ভাড়া দিতে হয়েছে।

এর আগে দশম সংসদে সংসদীয় কমিটি তদন্ত করে বলেছিল, সাড়ে তিন বছরে বিমানের আর্থিক ক্ষতি ৩০৫ কোটি টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ক্ষতি বেড়ে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা হলো কীভাবে? সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কারণে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না।

এর আগে উড়োজাহাজ ভাড়ার সিদ্ধান্ত ‘আত্মঘাতী’ উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, বিমান কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে নতুন উড়োজাহাজ কেনার চেয়ে ভাড়ায় আনতে উৎসাহী। এখানে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি আমরা জেগে ঘুমিয়ে ছিলাম। সবাই সবকিছু বুঝতে পারলেও কেন এত দিন কেউ কিছু বলেনি।

সরকার একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত নেয়, যার ফল হয় হিতে বিপরীত। ২০০৭ সালে বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করা হয়। সেই কোম্পানির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে উড়োজাহাজ ভাড়ায় আনা হয়। বলা হচ্ছে, সরকারঘনিষ্ঠ হওয়ায় বিমানের সেই চেয়ারম্যান বিমান মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ বা সুপারিশের তোয়াক্কা করতেন না। এখন আবার সরকারের মনে হচ্ছে, বিমানকে কোম্পানি করা ঠিক হয়নি। সে কারণে গত ১৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিমান মন্ত্রণালয়ের হাতে বিমানের নিয়ন্ত্রণ রেখে আইনের খসড়া অনুমোদিত হয়েছে।

এটা সত্য যে যাত্রীসেবার মান, সময়ানুবর্তিতাসহ নানা ক্ষেত্রে বিমান পিছিয়ে। এখন বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা ১৮। এ বছরের ৪ জানুয়ারি বিমান বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৪৮তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন করেছে। এই ৪৮ বছরের মধ্যে ২৮ বছরই ছিল লোকসানে। ২০১৭-১৮ সালে বিমানের লোকসান ছিল ২০১ কোটি টাকা, তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিমানের লাভ দেখানো হয় ২১৮ কোটি টাকা, বিমানের এই দাবি নিয়ে যদিও প্রশ্ন ওঠে। তবে নিয়মিত লোকসানের এই ধারাবাহিকতার মধ্যে ভাড়ায় উড়োজাহাজ এনে এভাবে বিপুল টাকা গচ্চা দেওয়ার বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না।

গত সেপ্টেম্বরে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে মন্ত্রণালয় জানায়, দায়দেনা পরিশোধ করে লিজ বাতিলের মধ্য দিয়ে গত মার্চ মাস থেকে উড়োজাহাজ দুটি থেকে বিমান মুক্ত হতে পেরেছে এবং ওগুলো ফেরত পাঠানো হয়েছে। এখানেই সবকিছু শেষ হতে পারে না। প্রশ্ন ওঠে, কে এবং কেন উড়োজাহাজ দুটি ভাড়ায় আনার চুক্তি করেছিল? তাদের খুঁজে পাওয়া কি কঠিন কিছু? রাষ্ট্রের টাকা এভাবে যাদের ব্যক্তিস্বার্থে অপচয় হয়েছে, তাদের ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।