এখন বিধিনিষেধ সফল হওয়া সম্ভব নয়

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন বিভিন্ন সময়ের অকার্যকর বিধিনিষেধ, বর্তমানে কার্যকর কঠোর বিধিনিষেধ তৈরি পোশাক ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য শিথিল করা এবং এ ধরনের বিধিনিষেধ বাংলাদেশের বাস্তবতায় কার্যকর করা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

সৈয়দ আব্দুল হামিদ
প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কথা ছিল ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ থাকবে। এখন দেখা যাচ্ছে ১ তারিখ থেকে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হচ্ছে। লকডাউন বা বিধিনিষেধ নিয়ে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে যা হলো, তাকে কীভাবে দেখছেন?

সৈয়দ আব্দুল হামিদ: আমাদের দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো, বাড়িঘরের বিন্যাস, পরিবারের সদস্য অনুযায়ী ঘরের কাঠামো, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, কোনোটাই দীর্ঘ মেয়াদে বিধিনিষেধ সফল করার অনুকূলে নয়। অন্যদিকে উপযুক্ত আর্থিক সহায়তা ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে বিধিনিষেধ পালনের সক্ষমতা সাধারণ মানুষ এবং বড়-ছোট কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেরই নেই। তৈরি পোশাকশিল্পসহ রপ্তানিমুখী খাত তো আরও স্পর্শকাতর, কেননা একবার বাজার হারালে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে তা ফিরে পাওয়া খুবই কঠিন। এমনিতেই ব্যবসাবান্ধব সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৬৮তম। আর দীর্ঘমেয়াদি বিধিনিষেধ এ ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ১ আগস্ট থেকে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আবার ডেলটা ভেরিয়েন্ট আসার পর বারবার বিধিনিষেধ দিয়েও সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। তাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধের বিকল্প ভাবাই সমীচীন।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বিশ্বের অনেক দেশ সফলভাবে বিধিনিষেধ কার্যকর করেছে, টিকা দিয়েছে, এখন শিথিল করছে। আমরা তো শুরু থেকে এ পর্যন্ত কোনো দফাতেই একটিও কার্যকর বিধিনিষেধ নিশ্চিত করতে পারলাম না।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ: বিধিনিষেধের সফলতা নির্ভর করে স্থান, কাল ও পাত্রের ওপর। উন্নত বিশ্বের সমাজ-সংস্কৃতিতে বিধিনিষেধ সফল করা অনেক সহজ। যেমন ধরুন পাব, নাইট ক্লাব ও পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ রাখলেই বিধিনিষেধ অনেকটা সফল হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা তো ভিন্ন। আর এটা না বুঝে বিধিনিষেধ দিলে তা তো সফল হওয়ার কথা নয়। প্রথমবার সারা দেশে বিধিনিষেধ বা সাধারণ ছুটি দেওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ, সংক্রমণ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ কিছু শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সারা দেশে বিধিনিষেধ দিয়ে তখনই বিধিনিষেধকে খেলো করে ফেলেছি। পরে বিধিনিষেধ মানুষের মনে তাই তেমন কার্যকর রেখাপাত সৃষ্টি করতে পারেনি। তার ফল তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। হ্যাঁ, উন্নত বিশ্ব টিকা উদ্ভাবন পর্যন্ত বিধিনিষেধ দিয়ে সংক্রমণ কমিয়ে রাখতে চেয়েছিল। টিকা আসার সঙ্গে সঙ্গেই গণটিকাদানের মাধ্যমে সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমাদের তো সেই সক্ষমতা কম। তাই আমাদের বিধিনিষেধ অনেকটা উদ্দেশ্যহীন বা হুজুগে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বিভিন্ন সময় যে বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো কি আসলে এটা দেখানো যে সরকার কিছু একটা করছে? আপনি কি মনে করেন না যে সরকারও জানে এসব কার্যকর করার বাস্তব পরিস্থিতি নেই?

সৈয়দ আব্দুল হামিদ: দেখুন, সরকারকে তো বহুমুখী চাপ সামলাতে হয়। বিধিনিষেধের পক্ষে যেমন যুক্তি আছে, তেমন বিপক্ষেও যুক্তি আছে। বিধিনিষেধ দেওয়া সরকারের জন্য নিশ্চয়ই সুখকর কিছু নয়। তবে পরিস্থিতির বাস্তবতায় সরকারকে এই অজনপ্রিয় এবং কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিধিনিষেধ যে পুরোপুরি সফল করা সম্ভব নয়, তা হয়তো কারও অজানা থাকার কথা নয়। তবে পরিস্থিতির বিবেচনায় অনেক সময় যুক্তির বাইরে গিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনি অবশ্য আগে থেকেই বলে আসছেন যে বিধিনিষেধ বাস্তবসম্মত নয়। এটা কি অর্থনৈতিক চাপ নেওয়ার অক্ষমতা, নাকি আমাদের ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা ও অদক্ষতার কারণে অসম্ভব?

সৈয়দ আব্দুল হামিদ: উভয়টাই। আগেও বলেছি, দীর্ঘ মেয়াদে বিধিনিষেধ সফল করার সক্ষমতা সাধারণ মানুষ কিংবা বড়-ছোট কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেরই নেই। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও উপযুক্ত পরিবার ও প্রতিষ্ঠান বাছাই করে আর্থিক সহায়তা প্রদানেও আমরা অনেক পিছিয়ে। দুর্বল স্থানীয় সরকারকাঠামো, অতীতের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে অনেক স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ওপর আস্থার সংকটসহ নানামুখী বাস্তবতায় আর্থিক সহায়তা পাওয়ার উপযোগী অনেক পরিবারকে বাছাই করা সম্ভব হয়নি। আর উপযুক্ত জনগণের কাছে আর্থিক সহায়তা পৌঁছাতে না পারলে বিধিনিষেধ যে সফল হবে না, তা কারও অজানা থাকার কথা নয়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: সরকার কোভিডকালে দরিদ্র মানুষের সাহায্য-সহায়তার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও তহবিল ও অর্থের বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ব্যবস্থাপনাগত অদক্ষতার কারণে তা–ও প্রকৃত অভাবী মানুষের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ: শক্তিশালী স্থানীয় সরকারকাঠামো এবং শুদ্ধ রাজনীতির চর্চা ছাড়া আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য সঠিক পরিবার বাছাই করা অনেকটাই অসম্ভব। এই দুই ক্ষেত্রেই তো আমরা অনেক পিছিয়ে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন সব উপযুক্ত পরিবারকে বাছাই করা সম্ভব হয় না, অন্যদিকে আমলা ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে, যা দেশের জন্য মোটেও সুখকর নয়। তবে কিছু উদ্ভাবনী উদ্যোগ, যেমন ৩৩৩ নম্বরে ফোনকলের মাধ্যমে খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দেওয়া নিঃসন্দেহে একটি ভালো দিক। এ ক্ষেত্রেও যাচাই-বাছাই করার জন্যও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতা দরকার।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বিধিনিষেধ নিশ্চয়ই আমাদের জন্য কঠিন। কিন্তু সংক্রমণ ও মানুষের জীবনের ঝুঁকির বিষয়টিকে কি উপেক্ষা করার সুযোগ আছে?

সৈয়দ আব্দুল হামিদ: কথায় আছে সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। সংক্রমণ এখন যে পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, তা বিধিনিষেধ দিয়ে বেশি দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তার প্রমাণ তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। অতি কঠোর বিধিনিষেধেও সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রতিদিন আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এটা সবারই জানা, বিধিনিষেধ স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। এটা মূলত সংক্রমণের মাত্রা কমিয়ে রাখার জন্য, যাতে স্বাস্থ্য খাত প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে রোগী ব্যবস্থাপনার পরিসর বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো কার্যকর বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। এ জন্য জনবলসহ চিকিৎসার সরঞ্জামাদি দ্রুত বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। দেশে প্রায় ৫০ হাজার বেকার চিকিৎসক এবং বিপুলসংখ্যক বেকার নার্স আছে। তাঁদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করা যেতে পারে। আবার মেডিকেল ও নার্সিং কলেজের চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের দ্রুত প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। মোটকথা, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হোক বা না হোক, জরুরি অবস্থার মতোই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তো বিধিনিষেধের পক্ষে মত দিয়ে আসছেন।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ: প্রথম দিকে অনেক দেশ বিধিনিষেধের মাধ্যমে সংক্রমণের বিস্তার রোধ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখন বিধিনিষেধ সফল হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে কেন বিধিনিষেধকেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার পরামর্শ দেব? পরিস্থিতি অনুযায়ী মত ও সিদ্ধান্তের পরিবর্তন প্রয়োজন। যুদ্ধের ময়দানে সম্মুখসমরে পেরে না উঠলে নিশ্চয়ই জেদের বশে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়াটা যৌক্তিক নয়।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ঈদের সময় বিধিনিষেধ শিথিল থাকা ও মানুষের চলাচলের কারণে এখন সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনেক।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ: আগেও বলেছি, সরকারকে নানামুখী চাপ সামলাতে হয়। ঈদুল ফিতরের সময় কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও ঈদে ঘরমুখী মানুষের ঢল বন্ধ করা যায়নি। তখন পরিস্থিতির বাস্তবতায় অনেকেই বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে গণপরিবহন খুলে দেওয়া হোক, যাতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমে। এ বাস্তবতা মাথায় রেখেই হয়তো সরকার কোরবানির ঈদে বিধিনিষেধ সপ্তাহখানেকের জন্য শিথিল করেছিল। সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃদ্ধির গ্রাফ তো বিধিনিষেধ শিথিলের আগে থেকেই ঊর্ধ্বমুখী। ঈদের বাড়তি চাপ এই ঊর্ধ্বমুখী ধারাকে আরও বেগবান করতে পারে, যা হয়তো সপ্তাহখানেকের মধ্যে স্পষ্ট হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বর্তমানের সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিস্থিতি যেখানে এসে ঠেকেছে এবং বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, এমন একটি বাস্তবতায় সরকার আসলে কী করতে পারে?

সৈয়দ আব্দুল হামিদ: চিকিৎসার পরিসর বাড়ানোর পাশাপাশি কাজটা কঠিন হলেও মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করা কিংবা বাধ্য করার বিকল্প নেই। আর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গণটিকাদান কর্মসূচি জোরদার করে আগামী ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সব নাগরিককে টিকার আওতায় আনতে হবে। মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিটি ক্ষেত্রের গ্রহণযোগ্য, বিশেষ করে ক্রীড়া, শিক্ষা ও সংস্কৃতিজগতের আইকনিক ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো যেতে পারে। নাটক-সিনেমাতেও মাস্ক পরার বিষয়ে উপযুক্ত ডায়ালগ সংযুক্ত করা যেতে পারে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ১ আগস্ট থেকে পোশাক কারখানা খুলছে, ৫ তারিখের পর বিধিনিষেধ থাকার কথা নয়। সবই যদি খুলে দেওয়া হয়, তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হচ্ছে কোন যুক্তিতে?

সৈয়দ আব্দুল হামিদ: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়ে নীতিনির্ধারণী মহলের অত্যন্ত দৃঢ় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন। আমাদের খামখেয়ালিপনায় শিক্ষার্থীদের জীবন সাংঘাতিকভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছি, যার প্রভাব ইতিমধ্যে ব্যাপকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। সংক্রমণের পারদ কবে ৫ শতাংশের নিচে নামবে, তা আমাদের কারও জানা নেই। এমনকি সবাইকে টিকার আওতায় আনলেও যে তা অর্জিত হবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলার কোনো অজুহাতই ধোপে টেকে না। সংক্রমণ এখন যেহেতু ঊর্ধ্বমুখী, তাই আগস্টে না খুললেও ১ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হলে সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে, যাতে কোনো রাজনৈতিক দল ভবিষ্যতে এ সিদ্ধান্ত থেকে কোনো বাড়তি ফায়দা নিতে না পারে। আর জনমত জরিপের সুযোগ তো সর্বদা আছে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।