তেঁতুলতলার প্রেরণায় সব মাঠ দখলমুক্ত হোক

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। ঢাকা শহরের মাঠ, উন্মুক্ত স্থান ও জলাভূমি নিয়ে গবেষণা করছেন। দেশের মাঠ রক্ষা ও এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেছেন।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ইফতেখার মাহমুদ

প্রশ্ন :

ঢাকায় তো মানুষ বেশি, জায়গা কম। এখানে খেলার জন্য মাঠ রাখা কতটুকু সম্ভব?

আদিল মুহাম্মদ: একটি শহর মানে শুধু রাস্তা আর বাড়িঘর নয়; শহরের মধ্যে মানুষের বসবাসের জায়গা আর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো থাকা জরুরি। মাঠ, জলাশয় ও গাছপালা হচ্ছে এর মধ্যে অন্যতম। আবার মাঠের মধ্যেও ধরন আছে। শিশুদের জন্য দু-এক বিঘার মধ্যে ছোট মাঠ, কিশোরদের জন্য মাঝারি মাঠ ও বড়দের জন্য বড় মাঠ বা উদ্যান দরকার হয়। যেকোনো পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় বসতি গড়ে ওঠার আগেই মাঠের জায়গা অধিগ্রহণ করে সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকার প্রায় দুই কোটি মানুষের জন্য কমপক্ষে ৬০০টি মাঠ দরকার। আছে মাত্র ২০০টি। এর মধ্যে মাত্র ৪০টি সাধারণ নাগরিক ও এলাকাবাসী ব্যবহার করতে পারে। বাকিগুলোর মালিক নানা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সেগুলোয় বাইরের লোকজন যেতে পারে না।

প্রশ্ন :

ধানমন্ডি ও উত্তরায় তো দেশের সচ্ছল এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বসবাস। সেখানেও কেন মাঠ রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না?

আদিল মুহাম্মদ: ধানমন্ডির সবচেয়ে বড় মাঠটি মূল পরিকল্পনায় উদ্যান হিসেবে রাখা হয়েছিল। সেটি এখন আবাহনী ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে। আরও কয়েকটি ক্লাবের নামে অন্য মাঠগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ এলাকাবাসীর মতামত ও চাহিদাকে আমলে নেওয়া হয়নি। মাঠগুলোয় এলাকাবাসীর অবাধ প্রবেশাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এটা মস্ত বড় অন্যায়। এ অন্যায়ের প্রতিবাদে নাগরিকেরা মাঠে নেমেছিলেন। আন্দোলন করেছিলেন। কোনো কাজ হয়নি। উত্তরায় আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার সময় সেখানকার সম্ভাব্য বসবাসকারীর তুলনায় কম মাঠ রাখা হয়েছিল। যে কটি মাঠ ছিল, তা–ও সেই নানা ক্লাবের নামে চলে গেছে। ওই ক্লাবের সদস্য ছাড়া স্থানীয় অধিবাসীরা সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ পায় না। খেয়াল করলে দেখা যাবে, মাঠগুলো নিয়ে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সব সময় নিশ্চুপ থাকেন। মাঠগুলো দখলমুক্ত করা নিয়ে আন্দোলন হলে ক্ষমতাবানেরা নীরব থেকে দখলদারদের সহায়তা করেন।

আরও পড়ুন
সরকার বড় অবকাঠামো নির্মাণ করছে। এসব মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা ও প্রবীণদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মাঠের বিকল্প নেই। মাঠে বিনিয়োগ করা হলে শত শত বড় অবকাঠামোর চেয়ে দেশ গঠনে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মানবসম্পদ হচ্ছে এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জনগোষ্ঠী যদি অসুস্থই থেকে যায়, তাহলে এত বড় বড় অবকাঠামো দিয়ে আমরা কী করব

প্রশ্ন :

পুরান ঢাকা এবং ঢাকার অন্য আবাসিক এলাকাগুলোর ক্ষেত্রে কী পরিস্থিতি দেখছেন?

আদিল মুহাম্মদ: পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, কলাবাগান, মিরপুর, বাসাবোসহ অন্য যেসব আবাসিক এলাকা, সেখানকার মাঠের জায়গায় কোথাও কোথাও সরাসরি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। মাঠে সারা বছর নানা ধরনের মেলার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। আর পাড়াভিত্তিক ছোট মাঠগুলোয় নির্মাণসামগ্রী, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের পণ্য রাখার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখি। কোথাও কোথাও মাঠ দখল করে বিপণিবিতান ও ভবন নির্মিত হচ্ছে। কলাবাগানে তেঁতুলতলার মাঠ নিয়ে আন্দোলন হওয়ার পর আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তারসহ অন্যান্য কারণে তা জাতীয় গুরুত্ব পেয়েছে। গণমাধ্যম এবং নাগরিক সংগঠনগুলো একযোগে ওই মাঠ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এটা একটা বড় অর্জন। এই আন্দোলনের বিজয় থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ঢাকার অন্য মাঠগুলো দখলমুক্ত করতে হবে।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পূর্বাচল, ঝিলমিলসহ নতুন অনেক আবাসিক এলাকা গড়ে তুলছে। সেখানে কি পর্যাপ্তসংখ্যক মাঠ রাখা হয়েছে?

আদিল মুহাম্মদ: পূর্বাচলে শুরুতে প্রয়োজনের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ মাঠ রাখা হয়েছিল। রাজউক থেকে বলা হয়েছিল ১০ লাখ মানুষ থাকবে। পরবর্তীকালে সেখানকার পরিধি বাড়িয়ে ১৫ লাখ মানুষের জন্য প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পূর্বাচলকে কেন্দ্র করে আরও শতাধিক আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। সেগুলোয় মাঠ নেই বললেই চলে। তার মানে সব কটি আবাসিক এলাকার চাপ পূর্বাচলের মাঠের ওপরে পড়বে। মূল ঢাকায় মাঠ নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা পূর্বাচলেও থেকে যাবে।

প্রশ্ন :

বুড়িগঙ্গার তীরে কেরানীগঞ্জ এবং সাভারের মতো এলাকাগুলোয়ও ঢাকা শহর অপরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। সেখানকার কী অবস্থা?

আদিল মুহাম্মদ: গত দুই যুগে কেরানীগঞ্জ ও সাভারে অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার পাশাপাশি আবাসিক এলাকাগুলো বড় হয়েছে। সরু অলিগলি আর নোংরা পরিবেশের মধ্যে গড়ে ওঠা এসব এলাকায় কোনো মাঠ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অপরিকল্পিত আবাসিক এলাকাতেও মাঠ গড়ে তোলা সরকারের দায়িত্ব। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ হলে সরকার সেখানে মাঠ ও পার্কের জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করে রাখে।

প্রশ্ন :

মাঠ নিয়ে আমাদের পরিকল্পনাবিদ ও নীতিনির্ধারকদের এ অবহেলার কারণ কী বলে মনে করেন?

আদিল মুহাম্মদ: ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধরন যদি আমরা লক্ষ করি, তাহলে দেখব, এখানে মানুষ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। এ শহরের জনসংখ্যা অনুপাতে যত মাঠ ছিল, তা সত্তরের দশক পর্যন্ত ঠিক ছিল। আশির দশক থেকে জনসংখ্যা দ্রুত বাড়লেও মাঠ সেই অনুপাতে বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি। ঢাকার অধিবাসীদের মধ্যে নানা ধরনের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা, বিষণ্নতা এবং কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। এর বড় কারণ মাঠ ও সামাজিক যোগাযোগের জন্য উন্মুক্ত স্থান আর উন্মুক্ত নেই। ঢাকায় এখন একটি ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটের অধিবাসীদের একে অপরের সঙ্গে চেনাপরিচয় পর্যন্ত নেই। বড়দের জন্য মাঠ থাকলে, পার্ক থাকলে ও শিশুদের জন্য খেলার ছোট মাঠ থাকলে যোগাযোগটা এমনিতেই বাড়ত। শহরে যে অপরাধপ্রবণতা, কিশোর গ্যাংসহ নানা ধরনের বৈকল্য তৈরি হচ্ছে, তা–ও কমে আসত। মাঠ না করে শত শত থানা করে লাভ নেই।

প্রশ্ন :

গ্রাম-মফস্বলের কী অবস্থা?

আদিল মুহাম্মদ: এখন মফস্বল শহরেও মাঠ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় কিছু মাঠ আছে, তবে তা সবাই ব্যবহার করতে পারে না। আর গ্রামে যে মাঠ আছে, তার বড় অংশ মৌসুমি, অর্থাৎ ফসল কাটার পর কিছুদিনের জন্য তা ব্যবহার করা যায়। বাকি সময় গ্রামের কিশোর-শিশু-তরুণদের মাঠ ছাড়া কাটাতে হয়।

প্রশ্ন :

তাহলে কি এখন মাঠ রক্ষা এবং নতুন করে মাঠ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কিছু করার নেই?

আদিল মুহাম্মদ: সরকার বড় অবকাঠামো নির্মাণ করছে। এসব মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা ও প্রবীণদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মাঠের বিকল্প নেই। মাঠে বিনিয়োগ করা হলে শত শত বড় অবকাঠামোর চেয়ে দেশ গঠনে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। মানবসম্পদ হচ্ছে এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জনগোষ্ঠী যদি অসুস্থই থেকে যায়, তাহলে এত বড় বড় অবকাঠামো দিয়ে আমরা কী করব।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আদিল মুহাম্মদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।