সবাইকে নিয়ে মালাটা গাঁথতে হবে

আসিফ সালেহ।
আসিফ সালেহ।
>

আসিফ সালেহ। উন্নয়নকর্মী। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সের সাবেক নির্বাহী পরিচালক। বর্তমানে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানত ব্র্যাক ও এনজিও খাতের ভূমিকা বিষয়ে তিনি জুমে প্রথম আলোর মুখোমুখি হন গতকাল শনিবার।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: ব্র্যাকের জরিপে ১৪ শতাংশ মানুষের খাবারের কষ্ট এবং ৬০ শতাংশ দারিদ্র্য বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল। কেমন আছে তারা?

আসিফ সালেহ: প্রথম কথা, খাবার না দিতে পারলে মানুষ বাঁচানো মুশকিল হবে। আমরা প্রাথমিক জরিপ করেছিলাম গত এপ্রিলে। তখন ত্রাণ খুব কম মানুষের কাছে পৌঁছেছিল। এখন শহুরে বা গ্রামীণ হতদরিদ্র যে–ই হোক না কেন, মাঠের চিত্র বলে দিচ্ছে, মানুষের অবস্থা খুব খারাপ। ত্রাণ ও কর্মসংস্থান জরুরি হয়ে পড়েছে। এপ্রিলের জরিপে আমরা দেখেছিলাম, দরিদ্র হলেও ঘরে অনেকের তিন থেকে ১২ দিনের খাবার মজুত ছিল। আমরা বর্তমানে দ্বিতীয় জরিপ করছি। যার ফল জুনে মিলবে। তখন বোঝা যাবে, তারা কতটা ত্রাণ পেয়েছে। বর্তমানে তাদের অবস্থা কী।

প্রথম আলো: আগের দুর্যোগের মতো এনজিওগুলো এবারে মাঠে নেই। প্রায় আড়াই হাজারের মধ্যকার সক্রিয় এনজিও প্রায় ৫০০। করোনাকালে এনজিও ব্যুরোতে গেছে ১৬টি। এনজিওগুলো কি ব্যর্থ? এনজিও কোয়ালিশন হবে?

আসিফ সালেহ: এর বহুমাত্রিক কারণ আছে। এনজিওকর্মীরা মানুষকে সংগঠিত করতেন। প্রাথমিক ঠেকাটা দিতেন। তত দিনে বিদেশি সহায়তা মিলত। আইলা–সিডরেও সেটা হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশে এনজিও কার্যক্রম সংকুচিত হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। তাদের সবার সামনেই একটি সম্পূর্ণ নতুন বাস্তবতা। আমাদের এনজিওগুলো প্রধানত উন্নয়নমুখী। তাদের ব্যর্থ বলা সমীচীন নয়। তাই ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা ছাড়া অন্যরা মাঠে তেমন নেই। বিদেশি দাতারা তহবিল না বাড়িয়ে বরং আরও হ্রাসের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে পাইপলাইনে থাকা বরাদ্দ থেকে হয়তো ৫০ ভাগ করোনায় খরচ করতে বলেছেন। কিন্তু অনেক এনজিওর সেটা ব্যবহার করার সামর্থ্য ছিল না। স্বাধীনতা থাকায় ব্র্যাক ব্যতিক্রম। তাই আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। আমরা ১০০ কোটি টাকার সঞ্চয় মানুষের হাতে এই বিপদের মধ্যে ফেরত দিয়েছি। আমাদের এক লাখের বেশি কর্মী ৬৪ জেলায় কাজ করছেন। ৩ লাখ ৪০ হাজার ৮৯১ পরিবার নগদ অর্থ এবং ১১ হাজার ৪১৮ পরিবার খাদ্যসহায়তা পায়। প্রায় ২৫ লাখ সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করেছে ব্র্যাক। এ ছাড়া ৫ কোটি ১৮ লাখ মানুষকে কোভিড-১৯ রোধে সচেতন করা হয়েছে। অনেক ব্যক্তি, সংস্থাও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তবে নেতৃত্বের অভাবে এনজিও কোয়ালিশন হয়নি। একটা উদ্যোগ চলমান আছে। তবে বড় তহবিল গঠনে খুব আশাবাদী নই। সার্বিক আন্তর্জাতিক সাহায্য আগামী কয়েক বছর বড় রকমের কাটছাঁটের মধ্য দিয়ে যাবে। আমাদের করোনা তহবিল এ পর্যন্ত ১৪ মিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে বিদেশি (মূলত অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও কানাডা) ৯ মিলিয়ন, নিজস্ব ২ মিলিয়ন ডলার এবং অন্য সূত্রে ৩ মিলিয়ন ডলার পেয়েছি। বিদেশিরা এর থেকে কম দুর্যোগেও অনেক দিয়েছে। তবে আমি এটা বলব না যে এনজিও খাত সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

প্রথম আলো: তাহলে মূল ভরসা ও দায় সরকারেরই?

আসিফ সালেহ: নেতৃত্ব সরকারই দেবেন। তবে স্থানীয় সম্পদ অনেক সংগ্রহ করতে হবে। সবাইকে কাজের ধরনে পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। দুই লাখ মানুষের কাছে আমাদের নগদ সাহায্য মোবাইলের মাধ্যমে গেছে। অন্য যারা এগিয়ে আছে, তাদের মধ্যে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন প্রচুর তহবিল গঠন ও বিতরণ করেছে। সাজিদা ফাউন্ডেশন একটি হাসপাতাল প্রদানসহ অনেক সহায়তা দিয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক হয়তো ব্যবস্থাপনাগত টানাপোড়েনে শুধু ক্ষুদ্রঋণেই আটকে আছে। প্রশিকা যথেষ্ট সংকুচিত। এভাবে অভ্যন্তরীণভাবে তহবিল কুড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবীর মাধ্যমে আরও সহায়তা দিতে হবে। অর্থায়নই বড় বাধা নয়। এনজিওগুলোর কাজে ধীরগতি এসেছিল। পরিবর্তনের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাওয়াতে তারা পারেনি। এসব ঘোচাতে হবে। আগামী ৩ বছর বা টিকা না আসা পর্যন্ত এর প্রভাব চলবে। তাই এনজিও বা সামাজিক সংগঠনগুলোকে তৈরি হতে হবে।

প্রথম আলো: আপনি লকডাউনের গোড়ায় বলেছিলেন, পাশ্চাত্যের মতো এখানে এটা কাজ দেবে না। এখন কী মূল্যায়ন?

আসিফ সালেহ: লকডাউন স্থায়ী সমাধান নয়। আমরা লকডাউনের বিরুদ্ধে ছিলাম না। বলেছি, এটা কার্যকর করতে হলে মানুষকে খাবার দিতে হবে। লকডাউন দিয়ে স্বাস্থ্য খাতসহ আনুষঙ্গিক খাতগুলো গোছানোর যে কাজ উচিত ছিল, সেখানে ঘাটতি থাকল। সমন্বয়ের কাজ হয়েছে, কিন্তু তা ধীরগতিতে। তাই লকডাউনের সুবিধা পুরোটা আমরা পাব না। এখন হাত ধোয়া ও মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতেই হবে। এটা অতিমারির প্রকোপ কমাবে। প্রতিটি হাসপাতালে কোভিড ও নন–কোভিড বিভাগ খোলারও পরিপত্র এসেছে। কিন্তু এসব কার্যকর করার পদক্ষেপগুলো দুর্বল। এগুলো দুর্বল থাকলে সুফল আসবে না। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ড. এ িব এম আবদুল্লাহ বলেছেন, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলো রোগীতে পরিপূর্ণ। সংক্রমণ আরও বাড়লে তখন কী হবে? আইসিইউর শয্যাসংকট তীব্র। এখন যদি আমরা অক্সিজেন সরবরাহ ভালো করতে পারি, তাহলে অনেক মানুষকে বাঁচানো যাবে। লকডাউন নাকি শিথিল লকডাউন, জীবন না জীবিকা? সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দুটোর মধ্যেই সমন্বয় সম্ভব, সেটা সম্ভবত আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

প্রথম আলো: সীমিত গণপরিবহনের ধারণা কাজ দেবে না। তাই অফিস–আদালত খুলে দেওয়ার ফলে আমরা ব্রাজিলের দিকে যাচ্ছি কি না, সেই শঙ্কাও কেউ কেউ করছেন।

আসিফ সালেহ: গণপরিবহন হবে সব থেকে বড় জায়গা, যেখানে নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করা না গেলে সংক্রমণের বড় বিস্তার ঘটতে পারে। পুলিশ দিয়ে এটা হবে না। লকডাউন ছাড়াও মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন করে সুফল পেয়েছে অনেক দেশ। জাপান ও ভিয়েতনাম ভালো উদাহরণ। জাপান উন্নত দেশ হলেও ভিয়েতনাম তো আমাদের মতোই। তাই আগামীর প্রতিটি পদক্ষেপে কমিউনিটির সম্পৃক্ততা অত্যন্ত জরুরি। সবাইকে একত্র করতে হবে। কোনোভাবেই সরকার এটা একা মোকাবিলা করতে পারবে না। আমরা সরকারকে এটা বলার চেষ্টা করছি। নিজেরা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে করছি। তবে সরকারের মধ্যে কাউকে ডেকে আনার আগ্রহটা একটু কম।

প্রথম আলো: গুরুত্বপূর্ণ কিছু করণীয় সম্পর্কে বলুন।

আসিফ সালেহ: প্রথমত সব ধরনের টেস্টিং বাড়ানো। গণস্বাস্থ্যের র‍্যাপিড কিটের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে হবে। ইতিমধ্যে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয়ত সরকারের জন্য সব থেকে জরুরি হয়ে পড়েছে, নতুন করে হট স্পট তৈরি হতে না দেওয়া। টোলারবাগ একটা ভালো উদাহরণ। আংশিক লকডাউন দিয়ে টোলারবাগকে ভাইরাসমুক্ত করা হয়েছে। এভাবে তথ্য যাচাই করে সম্ভাব্য হট স্পট রোধ করতে হবে। তৃতীয়ত, মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্বের অনুকূলে জনগণকে ব্যাপকভাবে সচেতন করতে হবে।

প্রথম আলো: অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদসহ অনেকেই বলছেন, সরকারের একলা চলো নীতি কাজ দেবে না।

আসিফ সালেহ: সম্পূর্ণ একমত। কেউ বলবেন, আমরা সবাই কেন এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ি না। এর উত্তর হলো, এটা এমন একটা সংকট, যার মোকাবিলায় সমন্বয় দরকার। শুধু এনজিও গিয়ে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করলে হবে না। কারণ, এর সঙ্গে একটা স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র, একটা টেস্টিং সুবিধার ব্যাপার থাকবে। তাই সরকারের নেতৃত্ব লাগবে। সেটা না থাকলে আমরা যা–ই করব, তার পুরো সুফল পাব না। অর্থায়নের জন্যও পাড়া, মহল্লাভিত্তিক বিত্তবানদের কাছে যেতে হবে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে সংগঠিত করতে হবে। এভাবে সবাইকে নিয়ে যদি মালাটা গাঁথা যায়, তাহলে আমরা একটা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। তা না হলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আসিফ সালেহ: ধন্যবাদ।