আতঙ্কটা কি করোনাকে নিয়ে, নাকি পুলিশের লাঠির বাড়ি নিয়ে? ভয়টা কি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুর, নাকি জরিমানা বা ক্ষণিকের আইনি দণ্ড! বিধিনিষেধে কী লাভ! পুলিশের গাড়ি চলে গেলে সবাই আবার আড়াল থেকে বের হয়ে যায়, আড্ডা দেয়, খুলে যায় চায়ের দোকান। পুলিশ দেখলে মাস্ক ওঠে নাকের ওপর। যেন করোনার জন্য নয়, পুলিশের সামনে পর্দা করার জন্য মাস্ক পরে সবাই! প্রতিদিন ঘরের বারান্দা থেকে রাস্তার এসব দৃশ্য দেখি। গত এক বছরে এসব দেখতে দেখতে ত্যক্ত।
বিধিনিষেধের মধ্যে একদিন আমার অসুস্থ বাবার জন্য খুব জরুরি পথ্য কিনতে আন্দরকিল্লায় এক দোকানে গেলাম। রিকশা নিয়ে, যথেষ্ট সুরক্ষা নিয়ে ও সামাজিক দূরত্ব মেনে। মূল সড়ক বাদ দিয়ে ভেতরের চিপাচাপা গলি দিয়ে রিকশাওয়ালা নিয়ে গেল। কী যে দেখলাম, আহা! ছোট ছোট মোড়ে, অলিগলিতে, ফাঁকা রাস্তায় মানুষ জটলা বেঁধে বেঁধে আড্ডা দিচ্ছে, চায়ের দোকানে চা খাচ্ছে, বাচ্চারা খেলছে, যেন ছুটির বিনোদন নিচ্ছে সবাই! কারও মুখে মাস্ক নেই বললেই চলে!
তা ছাড়া অনেক রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আরোহীর মাস্ক থাকলেও ড্রাইভারের মাস্ক থাকে না! ব্যক্তিগতভাবে গত এক বছরে যেকোনো যাতায়াতে আমি যে রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়েছি, তাদের যানে ওঠার আগেই মাস্ক পরা আছে কি না, দেখেছি। না থাকলে আমার ব্যাগ থেকে বের করে পরতে দিয়েছি।
আসল কথায় আসা যাক। দেখুন, নির্বাচনের সময় এলাকায় সারা দিন মাইকিংয়ের হুল্লোড় থাকা যায় না। বাড়ি বাড়ি লিফলেট যায়, প্রচার-প্রচারণা চলে, রাজনৈতিক কর্মীবাহিনীরা নিজেদের জন্য, রাজনীতির স্বার্থের জন্য হাত জোড় করে কাকুতিমিনতি করে ভোট চায়। করোনার মধ্যেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের হাল সুরত আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি। ঠিক ওভাবে, এবার না হয় দেশের স্বার্থের জন্য, অসচেতন মানুষগুলোকে বোঝানোর জন্য পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়, প্রয়োজনে বাড়িতে বাড়িতে কড়া নেড়ে নেড়ে বোঝান। সেটি অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনেই। এর জন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে একটি টিম গঠন করা যেতে পারে।
এত বিশাল জনসংখ্যার দেশে এমন একটি ভয়াবহ মহামারি নিয়ন্ত্রণ কঠিনতর কাজ। তারপরও চেষ্টা তো করা যায়। বিশ্বের অনেক দেশের নাগরিকেরা স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সফলতা দেখিয়ে করোনাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের আমরা অনুসরণ করতে পারি।
সাধারণ পাড়া-মহল্লার নিম্নমধ্যবিত্তরা, এমনকি অনেক শিক্ষিত মানুষ এখনো অসচেতন। কিছু হবে না টাইপের একটা অহংবোধ নিয়ে স্বাস্থ্যবিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দাপটে ঘুরে বেড়ায়। উচ্চবিত্তদের মতো নিজস্ব গাড়ি নেই, অনলাইনে অর্ডার করে ঘরে প্রয়োজনীয় সব আনার সামর্থ্যও অনেকের নেই। এই নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন চলাচল করতে হয়। স্বাস্থ্যবিধি জানা নয় শুধু, সেটি মেনে চলাটাও যে মুখ্য, তা তাদের বুঝাতে হবে। সংক্রমণ রোধে মানুষকে সচেতনতার আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই।
নমুনা পরীক্ষা ও টিকাদান কর্মসূচির পাশাপাশি গ্রাম, মফস্বল, শহর—সব জায়গায় মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মোবাইল অপারেটর, টিভি চ্যানেল, রেডিও, ফেসবুক অথবা অন্যান্য অনলাইন মাধ্যমকে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। বারবার বিধিনিষেধ আরোপ করে, মানুষকে পিটিয়ে, জরিমানা করে কোনা সংক্রমণ রোধ করা যাবে না। তা ছাড়া যেভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে, সেটিও ঠিকঠাক পালন করা যাচ্ছে না। সকালে এক সিদ্ধান্ত, রাতে আরেক সিদ্ধান্তের কারণে কোনো বিধিনিষেধই করোনা মোকাবিলায় কার্যকর হচ্ছে না।
জানি এত বিশাল জনসংখ্যার দেশে এমন একটি ভয়াবহ মহামারি নিয়ন্ত্রণ কঠিনতর কাজ। তারপরও চেষ্টা তো করা যায়। বিশ্বের অনেক দেশের নাগরিকেরা স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সফলতা দেখিয়ে করোনাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের আমরা অনুসরণ করতে পারি। শুধু টিকা দিলেই কাজ শেষ না। কারণ, টিকা দেওয়ার পরও আক্রান্ত হওয়ার খবর আমরা পাচ্ছি। ফলে আবারও বলছি, সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্ণধার ও জনপ্রতিনিধিদের এখনই উত্তম সময় দেশ ও জাতির প্রতি তাঁদের মহান দায়িত্ব পালনের। যদিও প্রায় দেড় বছর ধরে তাঁদের নানা কর্মকাণ্ডে আমরা হতাশ। ডাক্তার, নার্স, পুলিশসহ জরুরি সেবার সঙ্গে যুক্ত সবাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা আরও তৎপর হয়ে যাঁর যাঁর আওতাভুক্ত এলাকায় মহামারি মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে পারেন।
অন্তত একটা মাসের জন্য অথবা দুই সপ্তাহের জন্য হলেও সচেতনতা তৈরির একটি পরিকল্পিত প্রজেক্ট সরকার হাতে নিয়ে দেখুক। এতে দেশের জনগণের তথা মানুষের উপকারের পাশাপাশি সরকারের ভাবমূর্তিও কিন্তু উজ্জ্বল হবে। একজন সাধারণ নাগরিকের এই সাধারণ বিনয় বাক্যটুকু একটু চিন্তা করে দেখার সময় আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্ণধার ও জনপ্রতিনিধিদের হবে কি? দেশের স্বার্থে এটুকু করাটা কি খুব কঠিন কিছু হবে?
সাবরীনা সাবা
ফিরিঙ্গিবাজার, চট্টগ্রাম