নিয়োগ পরীক্ষায় দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্র যেভাবে মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে

বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, বেকার সমস্যা তার মধ্যে অন্যতম। পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। প্রচলিত অর্থে শ্রমশক্তির সেই অংশই বেকার, যাঁরা কর্মক্ষম, কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কাজের সুযোগ নেই। বেকারত্বের ধরন ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বেকারত্বকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন আর্থসামাজিক কাঠামোগত কারণ, অর্থাৎ মূলধনের অভাব; প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কর্মক্ষেত্রের সংকটে সৃষ্টি হওয়া বেকারত্ব। হঠাৎ কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে সৃষ্ট বেকারত্বকে বলা হয় আকস্মিক বেকারত্ব। প্রযুক্তিগত ও কারিগরি উন্নয়নের জন্য কর্মক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আসে, এর ফলে সৃষ্টি হয় প্রযুক্তিজনিত বেকারত্ব। কিছু কিছু উৎপাদন খাতে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কাজ হয়। এ অবস্থার বেকারত্বকে বলা হয় মৌসুমি বেকারত্ব। বাংলাদেশে মূলত কাঠামোগত বেকারত্বই বিরাজমান।

বেকারত্বের এসব প্রকারভেদ থাকলেও বেকারত্বের জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক হলো চাকরির নিয়োগে দুর্নীতি। কারণ, নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির জন্য যোগ্য ব্যক্তি তাঁর যোগ্য স্থান পাচ্ছেন না। এর ফলে বেড়েই চলেছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। একটা সময় পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব ছিল, তবে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল কর্মক্ষেত্রের সুযোগ। কিন্তু বর্তমান সময়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত বেকারদের পরিমাণ আকাশচুম্বী। কারিগরি শিক্ষার প্রতি বিমুখতা ও অতিমাত্রায় সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ কর্মক্ষেত্রে সৃষ্টি করছে নিয়োগ যুদ্ধ। আর এ অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে অনেক কুচক্রী মহল।

নিয়োগের ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে দুর্নীতির একটা চক্র। যাঁরা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পান, পরবর্তী সময়ে তাঁরা আরও বেশি দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁরা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অন্যদের নিয়োগ দেন। আর এভাবেই চলে আসছে দুর্নীতি। প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতির এই দুষ্টচক্রের কারণেই সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি রোধ করা যাচ্ছে না। দুর্নীতি দমন করতে চাইলে ভেঙে ফেলতে হবে এ দুষ্টচক্র। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি পর্যন্ত নিয়োগে ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নেন। প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এ ধরনের অভিযোগ শোনা যায়।

দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব কাজে লাগিয়ে একটি শ্রেণি অব্যাহতভাবে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ প্রক্রিয়াও দুর্নীতিকে উসকে দিচ্ছে। জানা যায়, সরকারি চাকরিতে বেতন বৃদ্ধির পর এ ধরনের নিয়োগে অবৈধ অর্থের পরিমাণও বেড়ে গেছে। তাই মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থায় নিয়োগ নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগের ক্ষেত্রেই অনিয়ম, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ বেশি। বেশির ভাগ নিয়োগে ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম আর স্বজনপ্রীতির কারণে বাদ পড়ছেন যোগ্য ও মেধাবী ব্যক্তিরা। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্র। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অযোগ্য ব্যক্তিরা নিয়োগ পাওয়ার ফলে সক্ষমতা হারাচ্ছে প্রশাসন।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়োগ নিয়ে আদালতের শরণাপন্নও হতে হচ্ছে চাকরিপ্রত্যাশীদের। এ সংকট নিরসনে নিয়োগে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের। যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি লাভ প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। যে বা যাঁরা এ অধিকার হরণ করছেন, তাঁরা গর্হিত অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। এ প্রবণতা বন্ধ করা দরকার কঠোরভাবে।

দুর্নীতির মাধ্যমে অযোগ্য ব্যক্তিরা চাকরির সুযোগ পেলেও বঞ্চিত হচ্ছেন মেধাবী প্রার্থীরা। এর ফলে মেধাবী প্রার্থীদের মধ্যে দেখা যায় তীব্র হতাশা। হতাশার একপর্যায়ে তাঁরা বেছে নেন আত্মহননের পথ। চাকরির জন্য ঘুষ প্রদান এখন একটি অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেকারদের এই আর্তনাদ শোনার যেন নেই কেউ। তাঁদের এই হতাশামোচন ও নিয়োগের এই দুর্নীতি রুখতে কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দুর্নীতি দমন কমিশনকে নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা। অন্যথায় দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত অযোগ্য প্রার্থীদের মাধ্যমে মেরুদণ্ডহীন একটি প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সুতরাং নিয়োগের স্বচ্ছতা রক্ষা এখন সময়ের দাবি।

মোহাম্মদ ইয়াছিন ইসলাম
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়