গাছের প্রাণ আছে, ক্রুশবিদ্ধ করা যে খুনের শামিল, তা কবে বুঝবে জনগণ?
এদিকে পাঠ্যপুস্তকের পড়ালেখা কখনো আমাদের চেতনায় সেঁধোয় না। পরীক্ষায় পাসের জন্য পড়া গিলে পরীক্ষাকেন্দ্রে বমি করার নামই পরীক্ষাব্যবস্থা। তা না হলে ছোটবেলা থেকে জগদীশ চন্দ্র বসুর ‘গাছেদেরও প্রাণ আছে’ পরীক্ষিত তথ্য পড়ানো হলেও গাছ কাটতে বা ক্রুশবিদ্ধ করতে জনগণের হাত কাঁপে না। খুন করেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান খুনিরা। দেশের দণ্ডবিধিতে আজও কোনো চরম শাস্তি হয় না। অথচ অন্যান্য প্রাণী নিধনে কড়া আইন আছে। আর এই সুযোগ নিয়েই গাছে পেরেক মেরে বিভিন্ন সাইনবোর্ড টাঙানো, এলইডি লাইট লাগিয়ে বিজ্ঞাপনের বাহার দেখাতে লজ্জাও করে না।
গাছে গাছে অত্যুজ্জ্বল আলো লাগিয়ে কোম্পানির দল বাহাদুরির প্রতিযোগিতা দেখায়। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের অভিমত, এই অত্যুজ্জ্বল আলোর বিকিরণ ও তেজস্ক্রিয়তায় গাছের বৃদ্ধি আর পুনরুদগমে ব্যাপক ক্ষতি হয়। শুধু তা–ই নয়, গাছের বাকলের নিচে যে সূক্ষ্ম ছিদ্র ও কলা থাকে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রাণরস আর জলীয়বাষ্প শুকিয়ে মরে যায়, ঠিক একইভাবে এই অত্যুজ্জ্বল আলোর তাপে গাছের প্রাণশক্তি কমে আসে। এটি এক অর্থে সেঁকো বিষ দিয়ে ‘স্লো পয়োজন’ করে মারার শামিল। আর গাছের গুঁড়িতে শক্ত করে এলইডি লাইট বাঁধলে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তারে আর গুঁড়ির বাড়বাড়ন্তে বাধা পায়।
গাছ যে আসবাব বা লোহার সরঞ্জাম নয়, সপ্রাণ জীব—এটা কি আজও চারিত হয়নি? তাহলে শ্রী জগদীশ চন্দ্র বসুর লেখা পড়ে লাভ কী? গাছের গায়ে রাতে জোরালো আলো লাগালে গাছে আশ্রয় নেওয়া পাখিদেরও জীবনধারা বদলে যায়। দিন আর রাতের পার্থক্য করতে না পেরে বিশ্রাম নিতে পারে না তারা। ফলে প্যাঁচা ও বাদুড়ের মতো নিশাচর প্রাণীরা অবলুপ্ত হবে। এই জোরালো আলো দেখে পতঙ্গকুল ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যু ডেকে আনে। ফলে পাখিদের খাদ্য কমে যায়। জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক ঘা পড়ে। বন্য প্রাণীজগতে নেমে আসে বিপর্যয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখা ‘কথামালা’ এখন আর পাঠ্যপুস্তক নেই। তাই ‘তোমাদের আনন্দ আমাদের মৃত্যুর কারণ’ নীতিবাক্য কোনো স্কুলেই আর শেখানো হয় না। এর নাম শিক্ষা!
প্রকৃতি ও পরিবেশ না বাঁচলে যে মানুষ বাঁচবে না, তা জনগণ আর কবে বুঝবে? অন্যের দিকে তাকানো বা তাদের আরও ভালোভাবে বাঁচার জন্য সহযোগিতার কথা জনগণ ভাবে না। বড্ড আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে পৃথিবীর মানুষ। সেই সঙ্গে হারিয়েছে সহিষ্ণুতা। শুধু নিজে আরও ভালো থাকার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে।
বনের পশুরা অনেক সময় খিদের জ্বালায় নিজের শাবককে খেয়ে ফেলে। কিন্তু মানুষ কোন খিদের জ্বালায় গাছ ও বন্য প্রাণী মেরে ফেলছে? নগরায়ণ বৃদ্ধি, আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়ন আর রাস্তাঘাটের চাকচিক্য বাড়াতে বৃক্ষ নিধন করেই চলছে। পরিবেশবিদেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘সাবাস চালিয়ে যান। দেখার কেউ নেই। গাছের পক্ষে কেউ নেই।’
মানুষ যদি গাছ কেটে সাফ করে দিতে পারে, বন্য প্রাণী মেরে ফেলতে পারে, তাহলে রাশিয়ার ইউক্রেন দখল নিতে দোষ কোথায়?
লিয়াকত হোসেন খোকন
রূপনগর, ঢাকা