একুশের গানের রচয়িতা হিসেবে দেশে প্রকাশিত প্রায় সব সংবাদপত্রের উপসম্পাদকীয় পাতায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নাম দেখে দেখে এতটাই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন যে লন্ডনে গিয়ে যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হলো, প্রথম দেখাতেই মনে হলো, তিনি আসলে খুব আপন একজন মানুষ। মানুষ হিসেবে তিনি সবার কাছে এলে তাই-ই ছিলেন, খুব দ্রুত ও সহজে তিনি যেকোনো মানুষকে কাছের করে নিতে পারতেন। অকপটে মানুষ গাফ্ফার চৌধুরীর কাছে ব্যক্তিগত সব দুঃখ-কষ্টের কথা বলতে শুরু করত বলে পরবর্তীকালে বারবার প্রমাণ পেয়েছি। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল।
একজন বিখ্যাত সাংবাদিক, একুশের গানের রচয়িতা হিসেবে জীবন্ত কিংবদন্তি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্কটা খুব সহজ, স্বাভাবিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তিনিই প্রস্তাব করেছিলেন, লন্ডন থেকে প্রকাশিত প্রাচীনতম বাংলা সাপ্তাহিক ‘জনমত’-এ যোগ দেওয়ার জন্য। সে অনুযায়ী ‘জনমত’-এর তৎকালীন সম্পাদক নবাব উদ্দিনের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। তাঁর অনুরোধ ফেলে দেওয়ার সক্ষমতা কোনো সম্পাদকের ছিল না। কারণ, প্রতি বুধবার ‘জনমত’ প্রেসে যাওয়ার আগে যাঁর লেখাটির জন্য সম্পাদক মহোদয় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন, তিনি আর কেউ নন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এটা কেবল ‘জনমত’ বলে নয়, দেশের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কাগজগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, সেখানেও সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে গাফ্ফার চৌধুরীর কলামটি এসে পৌঁছাল কি না, তাই-ই ছিল আলোচ্য বিষয়।
তখন ফোন-ফ্যাক্সের যুগ, ই-মেইলের যুগ মাত্র শুরু হব–হব করছে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে লন্ডনের সর্বত্র যাওয়া-আসা আমার, লোকে এ নিয়ে নানা কথা বলে, কিন্তু আমি তো দেখছি, শিখছি তাঁর কাছ থেকে। রিপোর্টিংয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল, কিন্তু সংবাদ-বিশ্লেষণ তথা কলাম লেখার ‘কারিগরি শিক্ষাটি’ গাফ্ফার চৌধুরী হাতে ধরেই শিখিয়েছিলেন।
মাসের শুরুতে তিনি এক প্যাকেট কলম কিনতেন, বেশ দামি বলপয়েন্ট কলম, কিন্তু ভেতরে কালি ভরা। এর আগে তিনি কী কলম দিয়ে লিখতেন, তা জানা নেই আমার, কিন্তু তখনই দেখেছি, ভি-ফাইভ বলে একটি কলম এক সপ্তাহেই শেষ হতো তাঁর লেখায়। তিনি সপ্তাহে অন্তত চারটি কাগজের জন্য লিখতেন, সঙ্গে আরও কিছু ‘খুচরো’ লেখা। ‘জনমত’-এর কলামটি বুধবার সকাল ১১টা নাগাদ এসে পৌঁছাত ফ্যাক্সযোগে। কাটাছেঁড়াবিহীন রুলটানা কাগজে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষরে সাড়ে তিন পাতার লেখা, এর চেয়ে কমও নয়, বেশিও নয়। প্রতি সপ্তাহের বিষয় আলাদা, ঘটনার বর্ণনার সঙ্গে নিজস্ব বিশ্লেষণ দিয়ে ‘আমিত্বহীন’ এক ঝরঝরে লেখা। ইচ্ছা করেই এই লেখা কম্পোজ করার দায়িত্বটি আমি নিয়েছিলাম। কম্পোজ করতে করতে পড়ে ফেলার আনন্দ তো ছিলই, সেই সঙ্গে গাফ্ফার চৌধুরীর লেখার ধরনটিকে যদি আয়ত্তে আনা যায়, সেই লোভও কাজ করত। বছর তিনেক ধরে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অসংখ্য লেখা শুধু কম্পোজ করেছি তা-ই নয়, এমনও হয়েছে যে গাফ্ফার ভাইয়ের শরীর খারাপ হয়েছে কিংবা হাতে ব্যথা (শরীরে তাঁর নানা অসুখ তখন, ব্যথা তার মধ্যে অন্যতম), ফলে তিনি বলেছেন, আর আমি লিখেছি, সেটা যদিও অনেক পরের কথা।
বৃহস্পতিবার ‘জনমত’ বেরিয়ে যেত সকালে, কাজ কম, ফলে সেদিন গাফ্ফার ভাই আসতেন পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেন–সংলগ্ন চিকস্যান্ড স্ট্রিটে গল্প করতে। যাঁরা যাঁরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী, সবাইকে তিনি আসার সময় দিতেন এখানে। দেশ থেকে আসা, ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আসা কিংবা যুক্তরাজ্যেই অন্য কোনো শহর থেকে আসা নারী-পুরুষ–নির্বিশেষে সবাইকে তিনি সময় দিতেন জনমত কার্যালয়ে। চলতে–ফিরতে অসুবিধা, লন্ডনের পশ্চিম-শহরতলি থেকে দুবার টিউব বদলে ব্রিকলেনে এসে পৌঁছাতেন সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ। অল্ডগেট ইস্ট থেকে ‘জনমত’ পর্যন্ত আসতে রাস্তায় তাঁকে একাধিকবার থামতে হতো, লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতেন, তখনো মুঠোফোন অতটা জনপ্রিয় হয়নি, গাফ্ফার ভাই মুঠোফোন ব্যবহারও করতেন না তখন, ফলে বেরোনোর সময় ফোনে জানাতেন যে বেরিয়েছেন। অনেক সময় অল্ডগেট ইস্টে গিয়ে দাঁড়াতাম তাঁকে নিয়ে আসার জন্য। এই যে পূর্ব লন্ডনের বাঙালি পাড়ায় গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে পায়ে-পায়ে হাঁটছি, সেটাও তখন মানুষের কাছে আলোচনার বিষয় ছিল। সেসব আলোচনাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাও আমাদের ছিল।
বাংলাদেশের যেকোনো সংকটে তা হোক শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা কিংবা হালে বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা পরীমনির ওপর পুলিশি খড়্গ নেমে আসা—গাফ্ফার চৌধুরীর প্রতিবাদী কলম সব বিষয়েই সবার আগে অগ্নিবাক্য ঝরিয়েছে। উলানিয়া থেকে এজওয়ার রোডের দূরত্ব তিনি কমিয়ে এনেছিলেন কলমের কালি দিয়ে, যা প্রতিদিনকার কাগজে অক্ষর হয়ে মানুষের চোখে-মনে-মননে স্বাচ্ছন্দ্যে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছে।
জনমত কার্যালয়ে গাফ্ফার ভাইয়ের জমানো আসর নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা যাবে, হয়তো কোনো দিন লিখবও। এসব আসরে দেশীয় রাজনীতি থেকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও অবশ্যম্ভাবীভাবে বিভিন্ন নারীর প্রসঙ্গ চলে আসত। গল্প বলিয়ে হিসেবে গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর কলমের মতোই রসাল। যেকোনো তুচ্ছ গল্পকে তিনি বর্ণনা ও বলার ভঙ্গিতে শ্রোতার কাছে রসময় করে তুলতে পারতেন।
তিনি নিজেই বলতেন, সাংবাদিকের কোনো বন্ধু হয় না, বন্ধু থাকতে নেই। বিষয়টি আমার সঙ্গে গাফ্ফার ভাইয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ভীতির জায়গা তৈরি করেছিল বটে।
কিন্তু তা–ও গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে চেনাজানা সম্পর্কের চেয়েও নিকট-সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল মূলত রাজনৈতিক বিশ্বাস ও পেশাগত দায়িত্বের মিল থাকায়। লক্ষ করেছি, সাংবাদিকতার বাইরে তিনি আসলে অন্য কিছু ভাবতেন না।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাজ্যে যখন বাধ্য হয়েই গাফ্ফার চৌধুরীকে থেকে যেতে হলো, তখন চার সন্তান ও অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে তাঁকে বড় ধরনের বিপদে পড়তে হয়েছিল। সামরিক শাসকের হাত বিদেশেও বিস্তৃত ছিল এবং গাফ্ফার চৌধুরীর মতো বঙ্গবন্ধু-ঘনিষ্ঠদের অনেককেই এর মূল্য দিতে হয়েছে। ‘স্ট্যার ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি’ নামের একটি পাইকারি ‘গ্রোসারি শপ’-এ চাকরি করেছেন এবং সংসার চালানোর চেষ্টা করেছেন। গাফ্ফার ভাইয়ের নিজের ভাষায় তিনি এ সময়কে ‘উঞ্ছবৃত্তিকাল’ বলে অভিহিত করতেন। এ সময়ে অসুস্থ হয়েও গাফ্ফার চৌধুরীর স্ত্রী সংসারের হাল শক্ত হাতে ধরে যে বাড়িটিতে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন, সেই বাড়িই নিজেদের নামে ক্রয়ের ব্যবস্থা করেন। ফলে থাকার জায়গার সুরাহা হয় বটে, কিন্তু সংসার যে কী করে চালাতেন, তার বর্ণনা ব্যক্তিগত আলোচনায় ভাবি প্রায়ই দিতেন, যা আসলেই নির্মম ছিল।
কিন্তু সংবাদপত্রের পোকা যদি একবার মাথায় ঢোকে, সেটি বের করার সাধ্য কারও থাকে না বলেই হয়তো একদিন এই কষ্ট করে কেনা বাড়িও বন্ধক রেখে গাফ্ফার চৌধুরী ব্রিটেনের মতো নির্বান্ধব জায়গায় আরেকটি সংবাদপত্র খোলার ঘোষণা দেন। কিছুদিন সেটি চললেও বছরখানেকের মধ্যে সে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হয়। নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন, ফলে সংসারে পুনরায় অচলাবস্থা তৈরি হয়। সেখান থেকে কী করে বেরিয়েছিলেন, সে গল্প বিস্তারে বলতে হবে অন্য কোনো দিন। কারণ, গাফ্ফার চৌধুরীর স্ত্রী শেলী ভাবি সেসব বিস্তারিতই বলেছিলেন আমাকে। আমার সঙ্গে যখন তাঁর পরিচয় হয়, তখন তিনি ‘সিনিয়র সিটিজেন’-এর মর্যাদা পেয়েছেন, রাষ্ট্রীয় পেনশন পাচ্ছেন। শেলী ভাবির চিকিৎসা খরচ লাগছে না, ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, কাজ করছে, বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ফলে একটা নির্ভার জায়গায় তিনি পৌঁছেছিলেন। কিন্তু তাতেও তিনি নিজেকে কলমজীবী বলতেন। কারণ, তাঁর হাতে তখন লিখে আয় করা ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না।
কত কথা লেখার আছে গাফ্ফার ভাইকে নিয়ে। গাফ্ফার চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে প্রায়ই মানুষকে বলতে শুনি, তিনি সব সময় মৃত মানুষকে ‘রেফারেন্স’ দেন, একই ঘটনা একেক দিন একেক রকম করে লেখেন। দীর্ঘ প্রায় তিন বছর তাঁর লেখা কম্পোজ পড়েছি, পাঠ করেছি আরও অনেক দিন ধরে, কিন্তু একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চোখে না পড়লেও কিছু বিষয়ের রেফারেন্স বা সাক্ষী যেমন শুধু তিনি নিজেই। এ রকম একটি ঘটনার কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে, তা হলো, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিউবার প্রেসিডেন্ট কাস্ত্রোর বিভিন্ন মন্তব্য, যা এখন মুখে মুখে ফেরে অনেকেরই। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেও তিনি একেক সময় একেক রকম বক্তব্য দিয়েছেন।
কিন্তু যে বিষয়টি এখন উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করতে চাই, তা হলো বছরের ডিসেম্বর মাসে গাফ্ফার ভাই ঢাউস আকারের একটি ডায়েরি কিনতেন। প্রতিদিন বাড়িতে ফিরে তিনি সেদিনের ঘটনাবলি, বিশেষ করে কার সঙ্গে দেখা হলো, কী কথা হলো তার সারাংশ লিখে রাখতেন। ১৯৭৫ সালেরও একটি ডায়েরি আমি দেখেছি গাফ্ফার ভাইয়ের বাসায়। এর আগেরগুলো নাকি হারিয়ে গেছে একাধিকবার বাড়ি বদলের কারণে, বিশেষ করে স্ত্রী অসুস্থ হলে তাঁকে নিয়ে লন্ডনে গিয়ে থিতু হওয়ায়। কিন্তু এর পর থেকে প্রতিবছরের ডায়েরি থরে থরে সাজানো ছিল তাঁর বইয়ের আলমারিতে। আমি নিশ্চিত যে এগুলো তাঁর লেখার ‘রেফারেন্স’ হিসেবে অমূল্য সম্পদ ও স্মৃতি ঝালাইয়ের জন্যও বিশেষ সম্ভার বটে। একজন সাংবাদিকের ডায়েরির মূল্য কতটা, সেটা সাংবাদিক মাত্রেরই জানা আছে। গাফ্ফার ভাইকে এ জায়গায় অন্তত অবিশ্বাস করার জো নেই আমাদের।
লন্ডনের শহরতলি এজওয়ার রোডের বাড়িটিতে গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে বহুবার বহুক্ষণ গল্প করেছি। আমাকে লেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের পত্রিকা সম্পাদকদের কাছে গাফ্ফার ভাই আবদার করেছেন, আমার ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা আমি সব সময় প্রকাশ করেছি, করি এবং করবও। লন্ডনে তিনি তাঁর শরীরটা নিয়ে থাকতেন বটে, কিন্তু সব সময় সঙ্গে নিয়ে চলতেন পুরো বাংলাদেশকে মাথার মধ্যে, চেতনার মধ্যে ও জীবনাচারেও। খেতে ভালোবাসতেন, অনেক পদ সামনে নিয়ে খেতে বসতে যে খুব পছন্দ করতেন, সেটি ব্যক্তিগতভাবে জানি। যদিও বহুমূত্র রোগের কারণে খাবারে নিষেধাজ্ঞা ছিল, কিন্তু গাফ্ফার চৌধুরী সেটা মানার পক্ষপাতি ছিলেন না।
জমিদার পরিবারে জন্মালেও কষ্টকর জীবনযাপনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় শিশুকাল থেকেই, একা একাই দাঁড়িয়েছেন, ভেঙে পড়েছেন, আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। লন্ডনের মতো শহরে তিনি পুরোপুরি একজন ক্ষমতাবান বাঙালি সাংবাদিক হিসেবে জীবন কাটিয়েছেন। বাংলাদেশের যেকোনো সংকটে তা হোক শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা কিংবা হালে বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা পরীমনির ওপর পুলিশি খড়্গ নেমে আসা—গাফ্ফার চৌধুরীর প্রতিবাদী কলম সব বিষয়েই সবার আগে অগ্নিবাক্য ঝরিয়েছে। উলানিয়া থেকে এজওয়ার রোডের দূরত্ব তিনি কমিয়ে এনেছিলেন কলমের কালি দিয়ে, যা প্রতিদিনকার কাগজে অক্ষর হয়ে মানুষের চোখে-মনে-মননে স্বাচ্ছন্দ্যে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছে। খুব কম লেখক-সাংবাদিক এই বিরল সৌভাগ্য ও সম্মান নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁদের মধ্যেও বিরলতম মানুষ।
মাসুদা ভাট্টি সাংবাদিক। ই-মেইল: [email protected]