মেয়েদের কোন অন্ধকূপে রাখব?

ছবি: আবদুস সালাম

সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ওঠার পর থেকেই অস্বস্তি শুরু হলো। অটোরিকশার লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে চালকের চাহনি দেখে অস্বস্তির কারণ পরিষ্কার হলো। মনে মনে চিন্তা করলাম, ৪০ পেরোনো এক নারীর এ অস্বস্তি হলে এ অবস্থায় আমার নিজের দুই মেয়ে বা অন্য কম বয়সী মেয়েরা পড়লে তাদের অবস্থাটা কেমন হবে?

কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয় থেকে রাতে বাসায় ফেরার জন্য অফিসের সিএনজি থাকে। অফিস থেকে এই পথটুকু যেতে বুঝতে পারি, আলো–আঁধারিতে অনেকগুলো চোখের চাহনি। এটা প্রায় নিত্যদিনের এবং এ এলাকায় কর্মরত প্রায় বেশির ভাগ নারীর মধ্যে এ ধরনের অনুভূতি হয়।

অফিস থেকে ফেরার পথে বাসার কাছাকাছি গিয়ে মনে হলো, ভ্যান থেকে কিছু শাকসবজি কিনে বাড়ি ফিরি। অফিসের সিএনজি ছেড়ে শাকসবজি কিনলাম। হাঁটাপথ। গলিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, কাজটা কি ঠিক হলো?

এ ঘটনাগুলো গত কয়েক দিনের। কেন যেন মনের মধ্যে একটা ভয় চেপে বসেছে। বারবার চোখের সামনে চলে আসে নিজের কিশোরী দুই মেয়ের মুখ। ওদের সামনে তো আরও লম্বা পথ। মা–বাবা ওদের কত দিন আগলে রাখবে? একা তো পথ চলতে হবে। আবার অজানা ভয়ে নিজেই কুঁকড়ে যাই।

প্রথম আলোতে কাজ করি, পেশাগত কারণে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, বখাটেপনার মতো ঘটনাগুলো নিয়ে কাজ করতে হয়। ভুক্তভোগী মেয়ে বা মেয়ের মা–বাবার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কেন যেন নিজেকে ওই অভিভাবকদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি। এ যে কি মানসিক যন্ত্রণা।

কথা প্রসঙ্গে এক মা বলছিলেন, ‘সকালে খবরের কাগজ কোথায় লুকাব তাই ভাবতে থাকি। স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা পত্রিকা পড়া শুরু করেছে। আর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিন দু–একটা ধর্ষণের খবর থাকেই। এ নিয়ে মেয়েরা নানা প্রশ্ন করে।’ ওই মা নিজেই যোগ করলেন, ‘লুকিয়েই–বা কী হবে? কবে কার মেয়ে এ ধরনের ঘটনার শিকার হবে, তা তো বলা যায় না। নিজেই যে ঘটনার শিকার হব না, তা–ইবা কে বলতে পারে?’

২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান খবরের (লিড) শিরোনাম ছিল, ‘তুলে নিয়ে ছাত্রাবাসে ধর্ষণ’। একই পৃষ্ঠার আরেকটি বড় সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘মা-বাবাকে বেঁধে পাহাড়ি তরুণীকে ধর্ষণ, আটক ৭’। পত্রিকাটির পরের দিনের লিডের শিরোনাম ছিল, ‘ধর্ষণের পরও ছাত্রাবাসে ছিলেন অভিযুক্তরা’। পরপর দুই দিন লিডে জায়গা পাওয়া সিলেটের খবরটির সারাংশ হচ্ছে—সিলেটের ১২৮ বছরের পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজের ফটকের ভেতরের মাঠে অনেকে বেড়াতে যান। শুক্রবার সন্ধ্যায় এক নববিবাহিত দম্পতি এমসি কলেজ এলাকায় বেড়াতে যান।

স্বামী রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে যান সিগারেট কিনতে। ফিরে এসে দেখেন, স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করছেন কয়েকজন তরুণ। স্বামী প্রতিবাদ করলে মারধর করে তাঁদের দুজনকে গাড়িসহ জোর করে তুলে নিয়ে যান ওই তরুণেরা। এরপর তরুণী কলেজের ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের শিকার হন। ওই স্বামী শাহপরান থানায় মামলায় যে ছয়জনের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত। আর ঘটনার পরও ধর্ষণকারীরা ছাত্রাবাসেই ছিলেন। তবে এ ঘটনার পর তরুণী ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি সাইফুর রহমানসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করাসহ বিভিন্ন তৎপরতা বেড়েছে।

গত ৩০ আগস্টের প্রথম আলোরই আরেকটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘স্বামীকে রাস্তায় বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ’। চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার ব্যস্ততম অক্সিজেন মোড় এলাকায় স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণের এ ঘটনায় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল পেয়ে পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করে। আটক করা আসামিরা সবাই ছিলেন অক্সিজেন মোড় এলাকায় সিএনজিটালিত অটোরিকশাচালক।

প্রথম আলোর প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, নগরের অক্সিজেন মোড়ে শফি নামের এক ব্যক্তি তাঁদের পথ আটকান। তাঁরা দুজন স্বামী-স্ত্রী নন দাবি করে তাঁদের পুলিশে দেওয়ার হুমকি দেন। একপর্যায়ে দুজনকে গাড়িতে তোলা হয়। স্বামীকে হাত-পা বেঁধে গাড়িতে বসিয়ে রাখা হয়। স্ত্রীকে পার্শ্ববর্তী এক কলোনিতে নিয়ে শফিসহ পাঁচজন ধর্ষণ করেন। ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন।

সিলেট ও চট্টগ্রামের এই দুই নারী কিন্তু স্বামীর সঙ্গে ছিলেন। সম্প্রতি খাগড়াছড়ির ঘটনাটিও গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আলোচনায় এসেছে। রাত দুইটায় বাড়ির সদর দরজা ভেঙে আট থেকে নয়জন ঘরে ঢুকে বাড়ির সবাইকে বেঁধে রেখে লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। একপর্যায়ে গৃহকর্তার বেশ খানিকটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা থাকা মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। যে গ্রামে ঘটনাটি ঘটে, সেখানে আছে একটি আনসার ক্যাম্প ও একটি পুলিশ ফাঁড়ি।

সম্প্রতি সাভারে কিশোরী নীলা রায়ের (১৪) ঘটনাটিও আলোচনায় এসেছে। এ কিশোরী ২০ বছর বয়সী অভিযুক্ত যুবক মিজানুর রহমানের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। নীলা ভাই অলক রায়ের সঙ্গে রিকশায় করে হাসপাতালে যাচ্ছিল। রিকশা থেকে টেনেহিঁচড়ে ছিনিয়ে নিয়ে নীলার গলায়, পেটে, মুখে ও ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করে মিজান পালিয়ে যান। স্থানীয় এক হাসপাতালে নেওয়ার পর নীলা মারা গেছে। নীলা পড়ত দশম শ্রেণিতে।

স্বামী, বাবা, ভাইয়ের সঙ্গে থেকেও নীলারা নিরাপদ থাকতে পারছে না। তাহলে একা নারী পথে কতটুকু নিরাপদ, সেই চিন্তা মাথা থেকে তাড়াতে পারি না।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য নিয়ে মাস–বছরওয়ারি নারী ও শিশু নির্যাতনের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। গণমাধ্যমে তো আর সব খবর জায়গা পায় না। তাই দেশে নীলা রায়দের ঘটনা কতটি ঘটছে, তা–ইবা কে জানে। আর পরিসংখ্যান দিয়ে কী হবে? নীলা রায়সহ যারা হারিয়ে যাচ্ছে, তারা তো আর ফিরে আসবে না। সিলেটের ঘটনায় গণধর্ষণের শিকার নারী বা খাগড়াছড়ির গণধর্ষণের শিকার নারী মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এই দুজনের কথা এখানে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করলাম। এ ধরনের ভুক্তভোগী নারীরা আবার স্বাভাবিক হতে পারবেন কি না বা হলেও তা কত দিন লাগবে, তা–ও এক অনিশ্চিত প্রশ্ন। চোখ বন্ধ করেও ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর বিধ্বস্ত ও শোচনীয় পরিণতি অনুভব করা যায়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে বলছিলেন, ধর্ষণ, বখাটেপনার মতো ঘটনাগুলো বৃদ্ধির পেছনে সমাজে নারীর প্রতি যে নেতিবাচক ধারণা; তা–ও একটি বড় কারণ। একটি ছেলেশিশু কোন পরিবেশ বড় হচ্ছে, বাড়িতে মা–বাবার সঙ্গে কেমন আচরণ করছে, সবকিছুই প্রভাব ফেলতে থাকে ওই শিশুর ওপর। পুরুষতান্ত্রিকতা তো আছেই। তাই শুধু আমরা যাঁরা মেয়ের মা–বাবা, তাঁরা সচেতন বা চিন্তায় অস্থির হলে তো সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। ছেলের মা–বাবাকেও তো সচেতন হতে হবে। সাভারের নীলা রায়ের ঘটনায় অভিযুক্ত মিজানের মা-বাবাকে অভিযোগ দিলে তাঁরা উল্টো নীলাকে মিজানের সঙ্গে কথা বলতে ও ফেসবুকে চ্যাট করার পরামর্শ দিতেন বলে নীলার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। অথচ মিজানের মা–বাবা ছেলেকে যদি ছেলে নয় একজন মানবিক মানুষ হিসেবে বড় করতেন, ছেলের বখাটেপনাকে প্রশ্রয় না দিতেন, তাহলে নীলা রায়কে প্রাণ দিতে হতো না।

১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর আরেকটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘যাত্রীবাহী বাসে আবার পোশাককর্মীকে ধর্ষণ’। গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন গণধর্ষণের শিকার এ তরুণী (২২)। চাকরির সন্ধানে ঢাকায় এসে বাড়ি ফেরার পথে যাত্রীবাহী বাসে ওই তরুণী গণধর্ষণের শিকার হন। ভোরে কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ওই তরুণীর মা বাদী হয়ে মামলা করলে পুলিশ কুমিল্লার তিশা প্লাস নামে একটি যাত্রীবাহী বাসের চালক আরিফ হোসেন ও তাঁর সহকারী (হেলপার) বাবু শেখকে গ্রেপ্তার করেছে। বাসের দরজা, জানালা বন্ধ করে দিয়ে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করেন চালক আরিফ হোসেন, তাঁর সহকারী বাবু শেখ ও বাসের সুপারভাইজার মো. আলম। পরে বাসচালকের সহকারী বাবু শেখ ওই পোশাককর্মীকে তাঁর বাসায় নিয়ে যান। সেখানে বাবু শেখ ও সুপারভাইজার আবার তাঁকে ধর্ষণ করে ঘর থেকে বের করে দেন। পরে ওই পোশাককর্মী বিষয়টি মুঠোফোনে তাঁর মাকে জানান।

গত ২১ জানুয়ারির প্রথম আলোর প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল, ‘ধর্ষণ করে হত্যার পরও স্বাভাবিক ছিলেন বাসচালক সোহেল’। ১৯ বছর বয়সী তরুণী মমতা আক্তার বাসে ওঠার পর সঙ্গে সঙ্গে বাসচালক সোহেল খান বাসের বাতি নিভিয়ে দেন। বাসে এ সময় আর কোনো যাত্রী ছিল না। এরপর বাসের ভেতর ফেলে মমতাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। শেষে লাশ রাস্তার পাশের একটা জঙ্গলে ফেলে রাখা হয়। ঢাকার সাভারের ধামরাইয়ে মমতাকে হত্যার দায় স্বীকার করে দেওয়া বাসচালক সোহেল খানের জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ১০ জানুয়ারি ধামরাইয়ের হিজলীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশের জঙ্গল থেকে মমতা আক্তারের লাশ উদ্ধার করা হয়। মমতা ধামরাইয়ের বিল্ডট্রেড ফ্যাক্টরির শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

মমতা যে কারখানায় কাজ করতেন, সেই কারখানাতেই চাকরি করতেন সোহেল। বাসটিও ছিল ওই কারখানার। প্রথম আলোতে পুলিশ কর্মকর্তা রাসেল মোল্লার বক্তব্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—‘মমতাকে খুন করার পর স্বাভাবিক ছিলেন বাসচালক সোহেল খান। খুন করার পর আবার বাসে করে কারখানার অন্য শ্রমিকদের নিয়ে যান। দুপুরের পর আবার সেই শ্রমিকদের বাসে করে যাঁর যাঁর গন্তব্যে দিয়ে আসেন।’
ধর্ষণ, খুনের মতো ঘটনা ঘটিয়েও অপরাধীরা স্বাভাবিক থাকছেন, তাঁদের কাছে একজন নারীকে ধর্ষণ বা খুন করে ফেলা কোনো বিষয়ই নয়। মূল্যবোধের অবক্ষয় আর কাকে বলে। এই অপরাধীদের হাত থেকে নারী ও মেয়েরা কেমনে নিরাপদে থাকবে? আইনকানুন বা সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম এ সমাজের মেয়ে ও নারীদের কতটুকু সুরক্ষা দেবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণ মামলায় মজনুর বিচার শুরু হয়েছে। ছাত্রী ধর্ষণের মামলার একমাত্র আসামি মজনুর বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন করেছেন।
গত ৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী রাজধানীর কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ড থেকে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে গলফ ক্লাব–সংলগ্ন স্থানে পৌঁছান। এ সময় আসামি মজনু তাঁকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেন। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর বাবা ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন। মজনু ধর্ষণ করার কথা স্বীকার করে ১৬ জানুয়ারি আদালতে জবানবন্দি দেন। পুলিশ আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, আসামি মজনু একজন অভ্যাসগত ধর্ষক। প্রতিবন্ধী ও ভ্রাম্যমাণ নারীদের ধর্ষণ করে আসছিলেন তিনি। সমাজে এই মজনুদের সংখ্যাটাও তো অজানা।


ধর্ষণ, বখাটেপনা নিয়ে কথা বলছিলাম সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, নারী অধিকারকর্মী রাশেদা কে চৌধূরীর সঙ্গে। তিনি কথা প্রসঙ্গে বললেন, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে মেয়েদের অন্ধকূপে রাখতে হবে। মগজে কথাটা ঢুকে গেছে। মেয়েদের কোন অন্ধকূপে রাখব?

মানসুরা হোসাইন, সাংবাদিক