সেদিন সবাই কেঁদেছিল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অটোরিকশার ভেতরে মেয়েটিকে দেখলাম। চেহারাটা খুব পরিচিত। কিন্তু তার নাম মনে করতে পারছিলাম না। আমি একটু অবাক হয়েই দেখছি তাকে। মেয়েটা অবশ্য অটোতে ওঠা অবধি ফোনের পর্দা থেকে চোখ সরায়নি।
অটোরিকশা ২ নম্বর গলিতে ঢুকে গেল। ওই গলির ১১ নম্বর বাসা আমার গন্তব্য। মেয়েটি অবশ্য ভাড়া মিটিয়ে ৩ নম্বর বাসায় নেমে গেল। আমিও একটু দূরে নেমে পড়লাম। বন্ধু জয়ের বাসা এখানেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সূত্রে আমার এই এলাকায় আসা। চারপাশের কিছুই তেমন চিনি না ভালো করে। জয় আমার সহপাঠী, এখানকার স্থানীয়। তাই বিপদে-আপদে আমরা ওর শরণাপন্ন হই। জয়ও হাসিমুখে এগিয়ে আসে। আমি আজও এসেছি টিউশনির খোঁজে। জয় ছাত্র ঠিক করে রেখেছে। আমি গেলে আমাকে নিয়ে ছাত্রের বাসায় যাবে। পরিচয় করিয়ে দেবে।
জয় বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখেই বলল, ‘চল।’ কথা না বাড়িয়ে ওর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। ও এসে থামল ৩ নম্বর বাসার সামনে।
—এই হলো সুপ্রিয়াদের বাসা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, সুপ্রিয়া কে?
—তোর স্টুডেন্ট। চল ভেতরে যাই।
আমরা বাসায় গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসলাম। কিছুক্ষণ পর নাশতা নিয়ে যে ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকলেন, তাঁকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললাম,
—আন্টি, আমাকে চিনেছেন?
ভ্রু কুঁচকে একদৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। আমি এবার নিজের পরিচয় দিলাম। আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন। একে একে বাসার সবার কথা জেনে নিলেন।
এবার আসি সুপ্রিয়া প্রসঙ্গে। ওরা ছিল আমাদের প্রতিবেশী। আর সুপ্রিয়া ছিল আমার খেলার সাথি। বয়সে বড় হলেও কখনো দিদি বলে ডাকিনি ওকে। এ নিয়ে বড়দের কাছে হাজারবার নালিশ করেও কোনো লাভ হয়নি। আমার আগেই স্কুলে যেত সুপ্রিয়া। আর স্কুলে শেখানো ছড়া-কবিতাগুলো ওর কাছ থেকেই মুখে মুখে শিখে নিতাম আমি। আর পাশাপাশি এই দুই পরিবারের সম্পর্কের গভীরতা তো ছিলই। ভালো কাটছিল দিনগুলো। কিন্তু সবকিছু পাল্টে দিল এক দুর্ঘটনা। সুপ্রিয়া মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল মাস খানেক। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে চলাফেরা, কথা বলা সবকিছুই পারত। কিন্তু নির্মম সত্যটা ছিল, ওর আর বুদ্ধির বিকাশ হবে না। মানসিকভাবে এই ছয় বছর বয়সী শিশুই থাকবে। ব্যাপারটা ওই দিন না বুঝলেও পরে বুঝেছিলাম যে কেন সেদিন সুস্থ সুপ্রিয়াকে দেখে কেঁদেছিল সবাই। দেখতে দেখতে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে গেলাম আমি।

আর সুপ্রিয়া! এখনো ধারালো জিনিসপত্র থেকে দূরে রাখতে হয় ওকে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মাকে না দেখলে কেঁদে ওঠে। একটি চকলেট দিলেই বাচ্চাদের মতো করে হাসে আর একটু কড়া করে ধমক দিলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। আমার অবশ্য এখন আর তেমন সময় হয় না ওর সঙ্গে খেলার। কিন্তু এভাবে আর কত দিন। ওর মা-বাবা এবার তাঁদের ঘরবাড়ি বেচে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ওকে নিয়ে ভারতে চলে গেলেন চিকিত্সার জন্য সুপ্রিয়ার নানুর বাসায়। তারপর সুদীর্ঘ নয়টি বছর পর আবার আজ দেখা ওদের সঙ্গে। বাকি ঘটনা আন্টির কাছেই শুনলাম।

ভারতে তিন বছর চিকিত্সার পর সুপ্রিয়া সুস্থ হয়। কিন্তু অসুস্থতার দিনগুলোর কথা আর তার মনে নেই। ওর মা-বাবা ওকে নিষ্ঠুর দিনগুলোর কথাও মনে করিয়ে দিতে চান না। তাই দেশে ফিরে ওকে নিয়ে এক নতুন জায়গায় বসতি গড়ে তোলেন। নতুন জীবন শুরু করেন। আজ সে নবম শ্রেণিতে পড়ে আর আমি তার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া টিউটর।

ভাবতেই অবাক লাগে, আমি আজ তাকেই পড়াব, যার কাছেই কিনা আমার ছড়া-কবিতার হাতেখড়ি। সুপ্রিয়া অবশ্য আমাকে চিনল না, হয়তো ওর চেনার কথাও নয়।