সত্যিই একদিন বাঘ এল

বিশাল বন সাফ করে লোকালয় তৈরি হচ্ছে। বাঘের বংশ নিপাত করে গড়ে উঠবে মানববসতি। নেতৃত্বে গ্রামের মোড়ল খায়ের মণ্ডল। বনের গাছগাছালি কাটায় মজুরি খাটে মহব্বত আলী। তার প্রায়ই ভয় হয়—হঠাৎ যদি হালুম করে বাঘ আসে!

শেষে সত্যিই একদিন বাঘ এল। জোছনা রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বেরিয়েছে মহব্বত। দেখে, তার উঠানে একটা বাঘ। যে সে বাঘ নয়, ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার! চাঁদের আলো পিছলে পড়ছে তার সোনার বরন গা থেকে।

এইটুকু জীবনে এমন ভয়ংকর সৌন্দর্যের মুখোমুখি আর কখনো হয়নি মহব্বত। আর বাঘটা এমন সময় চোখে পড়েছে, যখন তার থেকে দূরত্ব মাত্র চার-পাঁচ হাত। মহব্বত ভাবল, সে দুঃস্বপ্ন দেখছে না তো! বিশাল এক হাই ছেড়ে বাঘটা বুঝিয়ে দিল—না, এটা কোনো স্বপ্ন নয়, সত্যি!

যমের ভয়ে মহব্বতের ‘প্রকৃতির ডাক’ হ্যাং করল। নিজেকে হাটখোলার শতবর্ষী অচল বৃ‌ক্ষের মতো মনে হলো তার। পায়ের তলায় আচমকা যেন শত শিকড় গজিয়ে পাতাল ভেদ করে বহু দূর চলে গেছে। একচুলও নড়ার জো নেই।

এমন সময় বাঘটা বলে উঠল, ‘ডরাইছস? ডরের কিছু নাই। আমি নখদন্তহীন বাঘ। চাইলেও তোর কোনো ক্ষতি করতে পারব না।’
মহব্বত বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘তাজ্জব কারবার! এ তো দেখি আমগোর মতন কথা কয়!’
‘কথা না কইয়া উপায় কী! তোগোর জ্বালায় আমগোর তো বনে বাস করা দিন দিন কঠিন হইয়া যাইতাছে। এহন প্রকাশ্যে আহন ছাড়া গতি নাই। তাই অভিযোজনের চেষ্টা চলতেছে। কথায় আছে না—ঠেকায় পড়লে বাঘ আর ছাগলে এক ঘাটে জল খায়। এহন না হয় মানুষের লগেই বাস করুম!’
বাঘের কথায় মহব্বতের বুকে খানিকটা বল ফিরে আসে। সে খাতির জমানোর চেষ্টা করে বলে, ‘কিন্তু মামা, তুমি কথা শিখলা ক্যামনে? আর দাঁত-নখইবা গেল কই?’
‘আরে, ওই কীটনাশক খাইয়া রি-অ্যাকশন হইছে। কী ভেজাল কেমিক্যাল ছিল কে জানে? মরলাম তো না-ই, মাঝখান থিকা আমার দাঁত আর নখ ঝইরা গেল! আর হালুম-হুলুম লোপাট হইয়া মুখে মানুষের বোল ফুটল।’
‘তা—মামা, আমি এহনে তোমার লাইগা কী করতে পারি?’
‘দাঁত-নখ খোয়াইয়া শিকার করা বন্ধ। দুই দিন পেটে কিছু পড়ে নাই। এহনে দ্যাখ, চাইট্টা খাবার দিতে পারস কি না!’
‘খাবার!’ মাথা চুলকায় মহব্বত। এই অকেজো বাঘটাকে কী খাওয়াবে সে?
বাঘ কাতর হয়ে বলে, ‘দুইডা হুদা ভাত হইলেও চলব। নইলে আটার জাউ...!’
মহব্বতের মাথায় বুদ্ধির খেলে যায়। এই অকেজো বাঘটাই এখন হতে পারে তার দুপয়সা কামানোর উপায়।
‘আমারে দুইটা মিনিট সময় দেও মামু, আমি আইতাছি!’
এই বলে ঘটি নিয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে চলে যায় মহব্বত আলী। মাথায় বন বন করে ঘুরতে থাকে ফন্দির চরকা। হ্যাঁ, এই বাঘই হতে পারে তার আয়ের উৎস।
বাঘটাকে নিয়ে ঘরের ভেতর চৌকির তলায় লুকিয়ে রাখে মহব্বত। ভাত খেতে দেয়। ভেতো আমেজে ভোঁশ ভোঁশ ঘুমাতে থাকে বাঘ।
পরদিন সকালে বড়সড় একটা গামলা দিয়ে বাঘটাকে পথের ধারে বসিয়ে দিল মহব্বত। গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল, ‘আহেন ভাই, আহেন। দাঁত পড়া এই লুলা বাঘটারে কিছু সাহায্য কইরা যান। আফনেগো কীটনাশক খাইয়া হে অচল হইয়া গেছে। সাহায্য না করলে বাঁচত না!’
বাঘ মানুষ খায়। কাজেই এই হিংস্র পশু বাঁচুক—কে চায়? তবু দাতার অভাব হলো না। ফেসবুকে ভাইরাল হতে অনেকে দু-চার টাকা করে ওই গামলায় ফেলতে লাগল। বাঘ চরিয়ে খেয়ে মহব্বতের পোয়াবারো। এমন উমদা ডোনেশন এলে গায়ে-গতরে কে খাটে?
ফেসবুকে বাঘ নিয়ে মহব্বতের তেলেসমাতি দেখে খায়ের মণ্ডলের ভূলোক আঁধার। এখন তার গাছ কাটবে কে?
লোকজনও এসে খবর দিল, মহব্বত এক লুলা বাঘ দিয়ে ধান্দাবাজি শুরু করেছে। বাঘটা মানুষের মতো কথা বলে।
প্রথমে বিশ্বাস করল না খায়ের মণ্ডল। পরে মনে হলো, ময়না-টিয়ার মতো পাখি যদি কথা বলতে পারে, বাঘের মতো এমন প্রতাপশালী জানোয়ার পারবে না কেন? তা ছাড়া অলৌকিক ব্যাপার বলেও তো কথা আছে! এই বাঘের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেই হবে।
খায়ের মণ্ডলের হুকুমে কয়েকজন জোয়ান গিয়ে মহব্বতকে কনুই মেরে হটিয়ে চ্যাংদোলা করে বাঘটাকে নিয়ে এল। খায়ের মণ্ডল দেখে, লোকজনের কথা সত্য। বাঘটার দাঁত আর নখ নেই। তাহলে কথাও নিশ্চয়ই বলে।
মোড়ল আর বাঘ এখন মুখোমুখি। খায়ের মণ্ডল বাঘের চোয়ালে সজোরে একটা ঠোকনা মেরে বলল, ‘কী রে বেটা, তুই নাকি মানুষের মতন কথা কস? শিখলি ক্যামনে?’
‘বাঘের ওপর যে স্টিমরোলার চলতেছে, এই অত্যাচারেই কথা ফুটছে। নিপীড়িতেরা আর কত নীরব থাকবে?’
‘কথা শিখা আর কী হইব? নখদন্তহীন বাঘ তো অকর্মা। এইটা কোনো কাজে লাগে না।’
‘কে কইছে নখদন্ত নাই? এই সব ম্যাজিক দিয়া লুকাইয়া রাখছি। সময়মতো দেখবা। আসলে তো সবই আছে। এতক্ষণ অভিনয় করছি।’
‘এ্যাঁ, কস কী? বাঘ আবার ম্যাজিক, অভিনয়—এই সবও জানে! তা—অভিনয় ক্যান?’
‘তোমার কাছে আহনের লাইগা। যেভাবে বন্দুকধারী দিয়া নিজেরে সব সময় ঘিরা রাখো, কৌশল ছাড়া কাছে আহনের উপায় আছে?’
এই বলে হাসল বাঘটা। তার ছুঁচাল ছেদন-দাঁত দেখা যাচ্ছে। বাঘটা আচমকা এত জোরে গর্জন করল, চেয়ার উল্টে পড়ে মূর্ছা গেল মোড়ল।