গঞ্জালেজদের কাজ থামানো যাবে না

মস্কোয় জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম ডয়চে ভেলের স্প্যানিশ চ্যানেলের প্রতিবেদক গঞ্জালেজ থেরান খবর সংগ্রহে ব্যস্ত। ছবি: সংগৃহীত
মস্কোয় জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম ডয়চে ভেলের স্প্যানিশ চ্যানেলের প্রতিবেদক গঞ্জালেজ থেরান খবর সংগ্রহে ব্যস্ত। ছবি: সংগৃহীত

কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে রাশিয়া ও সৌদি আরবের মধ্যে খেলার লড়াই। বিশ্বকাপ ফুটবল, ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এর এবারের আসরের প্রথম খেলা। মস্কোয় জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম ডয়চে ভেলের স্প্যানিশ চ্যানেলের প্রতিবেদক হুলিয়েত গঞ্জালেজ থেরান ব্যস্ত খবর সংগ্রহ করতে। দুই ঘণ্টা ধরে সরাসরি সম্প্রচারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এই নারী সাংবাদিক। একজন ক্রীড়া সাংবাদিকের জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা এই বিশ্বকাপ ফুটবল, তাই সবকিছু ঠিকঠাকমতো হওয়া চাই। সরাসরি সম্প্রচার শুরু হয়, সাবলীলভাবে সংবাদ উপস্থাপন শুরু করেন হুলিয়েত। হঠাৎ করে এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে হাত দিয়ে তাঁর বুকে চাপ দিয়ে, গালে চুমু দিয়ে চলে যান। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেও পরিস্থিতি সামলে নেন তিনি। নিজের কাজ শেষ করেন।
পরে জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম ডয়চে ভেলে কর্তৃপক্ষকে গঞ্জালেজ থেরান জানান, সরাসরি সম্প্রচারের জন্য তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে ঘটনাস্থলে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কোনো সমস্যায় পড়েননি। যখনই সরাসরি সম্প্রচারের কাজ শুরু হয়, তখনই পরিস্থিতির সুযোগ নেন যৌন হয়রানিকারী।’ তিনি বলেন, ‘কাজ শেষ হওয়ার পর ওই ব্যক্তিকে আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। কিন্তু ততক্ষণে তিনি পালিয়েছেন।’
যৌন নিগ্রহের ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে দেওয়ার পর নারী সাংবাদিকদের প্রতি আরও শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করার আহ্বান জানান গঞ্জালেজ থেরান। তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ কাম্য নয়। কাজের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভালোবাসা ও হয়রানির মাত্রাটাও বোঝা দরকার।’
হুলিয়েত গঞ্জালেসের এই ঘটনায় তোলপাড় হয় বিশ্ব গণমাধ্যমে। বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো বড় আসরে যেখানে নারী-পুরুষ একসঙ্গে মিলেমিশে খেলা দেখছেন, যাঁর যাঁর দায়িত্ব পালন করছেন—সেখানেও একজন নারীকে তাঁর দায়িত্ব পালনের সময় যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
কোনো আন্দোলন, ধিক্কার যেন ঠেকাতে পারছে না যৌন নিগ্রহকারীদের। লজ্জা, অপমান কিছুই যেন তাঁরা গায়ে মাখছেন না। ধৃষ্টতা দেখিয়ে বেপরোয়া আচরণ করেই যাচ্ছেন।
গত বছর থেকে বিভিন্ন দেশে রাজনীতি, ব্যবসা, শিল্প-সংস্কৃতি জগতের শীর্ষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌন অত্যাচারের অনেকগুলো ঘটনা প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন কিছু নারী। হলিউডের শীর্ষ একজন প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল এই নীরবতা ভাঙার পালা। বিভিন্ন পেশায় যৌন নির্যাতনের বা হয়রানির প্রতিবাদে হ্যাশট্যাগ ‍(#) ‘মি টু’ দিয়ে এখনো প্রচারণা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তারপরও কি থেমেছে?
গত ডিসেম্বরে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানে টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করে এমন নারী সাংবাদিকদের একটি দল ‘কোনো বোনকে পেছনে ফেলে যাব না’—এমন এক অঙ্গীকার করেছে। একা পথচলায় ভয়ংকর যৌন নিগ্রহের শিকার হয়ে হৃদয়বিদারক সব ঘটনাই তাদের এ শপথ নিতে বাধ্য করেছে। দেশটির মাজার-ই শরিফ শহরের আরিয়ানা টেলিভিশনের এক নারী প্রতিবেদক রায়হানা রাসোলি বলেন, ‘যৌন নিগ্রহের কোনো ঘটনা যখন আমাদের সামনে আসে, আমরা নারী সাংবাদিকেরা বিষয়টি ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারি। কারণ আফগানিস্তানে কোনো মেয়ে বা নারী যদি তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার বিচার চান তাহলে তাঁর গায়ে কত কলঙ্কই না লেপন করা হয়।’
চলতি বছরের মার্চে ব্রাজিলের নারী ক্রীড়া সাংবাদিকেরা কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সরব হওয়ার জন্য সম্মিলিত আহ্বান জানান। এ জন্য তাঁরা একটি প্রচার আন্দোলনও শুরু করেছেন। ‘লেট হার ওয়ার্ক’ স্লোগানে শুরু হওয়া আন্দোলনটি দেশটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলে। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করা ৫২ জন সাংবাদিক সে সময় জানান, তাদের অনলাইনে হয়রানিমূলক বার্তা ও ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাঁরা একটি ভিডিও প্রকাশ করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এতে দেখা যায়, এক নারী সাংবাদিক যখন সংবাদ তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তখন এক পুরুষ তাঁর মুখ চেপে ধরে হয়রানির চেষ্টা করছেন, কেউ চুমু খেতে আসছেন, গায়ে হাত দিচ্ছেন, কেউ বা নোংরা মন্তব্য করছেন। প্রতিটি অভিজ্ঞতা প্রচণ্ড ভয়ংকর বলে জানান ওই নারী সাংবাদিকেরা।
২০১৭ সালে এমনই লজ্জাজনক এক ঘটনা ঘটিয়ে নিষিদ্ধ হন ফ্রান্সের টেনিস খেলোয়াড় ম্যাক্সিমে আমু। টিভিতে সরাসরি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় ম্যাক্সিমে আমু এক নারী সাংবাদিকের ঘাড় ও কাঁধে হাত রেখে জোরে চেপে ধরে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন। এমন আচরণ করায় ফ্রেঞ্চ ওপেন চত্বরেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে ২১ বছর বয়সী ওই খেলোয়াড়কে।
বিশ্বের সর্বত্র সর্বকালে পুরুষের হাতে মেয়েদের যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ক্ষমতার চাবি পুরুষের হাতে, তাঁরাই আইন বানান, তাঁরাই বিচার করেন। ফলে অভিযোগ করেও মেয়েরা বিচার পাননি। অফিস-আদালত, কারখানার নারী শ্রমিক থেকে শুরু করে নারী পুলিশও নিগ্রহের শিকার হয়েছেন এমন নজির রয়েছে।
সম্প্রতি বিবিসি ‘দ্য কমরেস পোল’ নামে যুক্তরাজ্যে নারী ও পুরুষদের যৌন হয়রানি নিয়ে এই জরিপ চালায়। এতে দেখা যায় যুক্তরাজ্যে কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় অর্ধেক নারী যৌন হয়রানির শিকার হন।
হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের (সিএইচআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুরুষ পুলিশ সদস্যদের হাত থেকে রেহাই পান না নারী পুলিশ সদস্যরাও। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে পুলিশে কর্মরত নারী কনস্টেবলদের ১০ ভাগের বেশি সদস্য কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হন।
আগে নারীদের ওপর ঘটা এসব ঘটনাকে নারীর লজ্জা বলেই চাপিয়ে দেওয়া হতো। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারতের মতো দেশগুলোতে ধর্ষণের শিকার নারীকেই পাথর ছুড়ে মারা হয়েছে। লজ্জা, কলঙ্ক, অপবাদ দিয়ে নারীর প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা তো চলছে যুগ যুগ ধরেই। কিন্তু অবস্থাটা বদলাতে শুরু করেছে, আর এই পরিবর্তন শুরু হচ্ছেন মেয়েদের হাতেই।
মার্কিন প্রভাবশালী গণমাধ্যম ফক্স নিউজের প্রধান নির্বাহী রজার এলস, হলিউডের নামজাদা প্রযোজক হার্ভি ওয়েনস্টিন, সিনেটর আল ফ্রাঙ্কেন, অভিনেতা কেভিন স্পেসি এ রকম শ খানেক নামীদামি মানুষ কিন্তু ধরাশায়ী হয়েছেন। কেউ চাকরি খুইয়েছেন, কেউ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, কেউবা নাকে খত দিয়ে বলেছেন যে ভুল হয়েছে, আর করব না।
যৌন নিগ্রহের শিকার হয়ে নারী সাংবাদিকেরা কিন্তু চুপ করে থাকেনি। অপরাধীদের চেহারাটা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। ব্রাজিলের নারী সাংবাদিকেরা তাঁদের ভিডিওতে বলেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। এটা অপমানজনক, আপত্তিকর, সহিংস আচরণ। এ রকম আর হতে দেওয়া হবে না।’
ডয়চে ভেলের গঞ্জালেজ থেরানের প্রতি শ্রদ্ধা আসে। জঘন্য ওই পরিস্থিতির শিকার হয়েও নিজের কাজ বন্ধ করেননি তিনি। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুরো ভিডিওসহ প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ওই ব্যক্তির কুৎসিত মুখটা তো চিনেছে সবাই। তবে এ রকম কুৎসিত পরিস্থিতি দিয়ে গঞ্জালেজ থেরানদের কাজ যে থামানো যাবে না তার প্রমাণ তো তিনি দিয়েই দিয়েছেন!