সবার আগে ওদের কথা শুনুন!

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

তুহিন (ছদ্মনাম) একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় চিঠি গেল তাঁর টিউশন ফির টাকা বকেয়া পড়েছে! বাবা-মা যোগাযোগ করে জানতে পারলেন, বাসা থেকে টাকা নিয়েও সেটা জমা দেননি, উপরন্তু পরীক্ষায়ও খারাপ করেছেন। ইদানীং তুহিনের আচরণ অনেক রূঢ় হয়ে উঠেছে, কথায় কথায় রেগে যান, দিনের বেলায় ঘুমান আর রাতে জেগে থাকেন। স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়েছে।

খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল, ইয়াবার নেশায় জড়িয়ে পড়েছেন তুহিন। বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে বাবা-মা তাঁকে নিয়ে গেলেন মনোচিকিৎসকের কাছে। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর নেশামুক্ত হয়ে আবার পড়ালেখা শুরু করেছেন তুহিন।
নেশায় জড়িয়ে পড়া বা ‘মাদকাসক্তি’ একটি রোগ বা ব্যাধি। সাধারণ সামাজিক সমস্যা বলে এটাকে হালকা করে দেখার কিংবা অপরাধ বলে এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই! মাদকাসক্তিকে বলা হয় ‘ক্রনিক রিলাপসিং ব্রেইন ডিজিজ’ বা বারবার হতে পারে এমন রোগ। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করলে এ রোগ থেকে নিরাময় সম্ভব।
প্রথম দিকে কৌতূহলের বশে বা বন্ধুদের তাড়নায় কিংবা সাময়িক কোনো হতাশার কারণে বা নিছক শখ ও ফ্যাশন হিসেবে কেউ মাদক গ্রহণ করে। এরপর ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার (একধরনের রাসায়নিক পদার্থ) ও রিওয়ার্ড সেন্টার (আনন্দ অনুভব করার জায়গা) ক্রমাগত মাদক গ্রহণ করার জন্য শরীরকে বার্তা পাঠায় এবং একপর্যায়ে ব্যক্তির শরীর ও মন মাদকনির্ভর হয়ে পড়ে।
মাদক মানেই রাসায়নিক এই দ্রব্য মস্তিষ্কে প্রবেশ করে আসক্ত ব্যক্তির চিন্তা আর আচরণকে অস্বাভাবিক করে ফেলে। এ সময় তার পড়ালেখার মান নষ্ট হয়, কর্মক্ষেত্রে কাজের মান নিচে নেমে যায়, সামাজিকভাবে সে নিজেকে গুটিয়ে রাখে আর পরিবারের মধ্যে এক অচেনা সদস্য হয়ে যায়। মা-বাবা বা কাছের মানুষেরা তার আচরণে অনেকখানিই আন্দাজ করতে পারেন, কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে চিকিৎসকের কাছে তো নেন-ই না, এমনকি স্বজনদের কাছ থেকেও তাকে লুকিয়ে রেখে মাদকাসক্তির বিষয়টি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষও এ ধরনের ছাত্রকে পারলে বহিষ্কার করে দেয়। আর চাকরিজীবী হলে তাঁর চাকরিটা চলে যায় অথবা সবচেয়ে গুরুত্বহীন জায়গায় তাঁকে বদলি করা হয়। বিবাহিত হলে অনেক সময় সম্পর্কচ্ছেদ হয়ে যায়।
মাদকের জন্য অর্থের জোগান যখন স্বাভাবিক পথে না আসে তখন চুরি, ছিনতাই ইত্যাদিসহ ছোট-বড় নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে সে। মাদকের কারণে শরীরের নানা অঙ্গ (লিভার, কিডনি, হার্ট) ÿক্ষতিগ্রস্ত হয়, মাদকজনিত মানসিক সমস্যা তৈরি হয়, এমনকি হেপাটাইটিস বি, সি ও এইচআইভি সংক্রমণেরও শিকার হতে পারে সে। চুরি-ছিনতাই যারা করতে পারে না, তারা অর্থের জোগান পেতে নিজেই জড়িয়ে পড়ে মাদক কেনাবেচার ব্যবসায়। ফলে সে অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে।
অন্যকে মাদকের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে নানা ভুল তথ্য ও ধারণার প্রচার রয়েছে। যেমন অমুক মাদক গ্রহণ করলে মেধা বাড়ে, পড়ালেখার উন্নতি হয়। অমুক মাদকের ব্যবহারে শরীরের মেদ কমে, অমুক মাদকে সৃজনশীলতা বাড়ে ইত্যাদি। এসব তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। পৃথিবীতে এমন কোনো মাদক নেই, যার একটিরও ভালো দিক আছে। কোনো মাদকেই সৃজনশীলতা বাড়ে না, মেধা বাড়ে না এবং দেহসৌষ্ঠবও সুন্দর হয় না। বরং যেকোনো মাদকের ক্রমাগত ব্যবহারে বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে যায়, কর্মস্পৃহা নষ্ট হয় এবং মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত দেহের প্রতিটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, মাদকাসক্ত ব্যক্তি কোনো অপরাধী নয়, সে অপরাধের শিকার এবং ‘মাদকাসক্তি রোগ’-এ ভুগছে। তার চিকিৎসা প্রয়োজন।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধসংক্রান্ত দপ্তর (ইউএনওডিসি) ১৯৮৭ সাল থেকে ২৬ জুন দিনটিকে ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এ দিবস ঘিরে যে বিষয়টির দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তা হলো, ‘আগে শোনো (লিসেন ফার্স্ট)’।
শিশু আর তরুণদের সুস্থ ও নিরাপদভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করার প্রথম ধাপ হচ্ছে তাদের কথা মন দিয়ে শোনা। সবার আগে তাদের মনের কথাগুলো শুনতে হবে। তারা কী বলতে চায় তা বুঝতে হবে—তাদের আবেগ আর অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল হয়ে সাড়া দিতে হবে।
বাংলাদেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের প্রায় ৬৩ শতাংশই হচ্ছে কিশোর ও তরুণ। ইউএনওডিসি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রচারপত্রে বলা হয়েছে, যেসব শিশু-কিশোরের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক নিবিড়, তাদের মাদকাসক্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যারা অল্প বয়সে মাদক গ্রহণ শুরু করে, তারা সহজেই মাদকনির্ভর (ডিপেনডেন্ট) হয়ে যায়, যা মাদকাসক্তি রোগের গুরুতর পর্যায়। নেশা প্রতিরোধে আর মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত হতে প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা, পরিবারের সহমর্মিতা আর বন্ধুদের সহায়তা। যে মাদক নিতে প্রলুব্ধ করে, সে বন্ধু নয়। বরং যে মাদক গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু। বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা আর সবার সহযোগিতাই একজন তরুণকে মাদকমুক্ত রাখতে পারে।

>

মাদকসক্তি রোগের সাধারণ লক্ষণ
 লেখাপড়ায় খারাপ করা, কাজে মনোযোগ কমে যাওয়া
 কারণে-অকারণে মিথ্যা কথা বলা
 উগ্র আর রূঢ় আচরণ করা, মেজাজ খিটখিটে থাকা
 নিজের ক্ষতি করা (হাত কাটা, হাত পোড়ানো, মাথায় আঘাত করা ইত্যাদি)
 রাতে জেগে থাকা আর দিনের বেলায় ঘুমানো
 যখন-তখন বাইরে যাওয়া, বেশি রাতে ঘরে ফেরা
 বিনা কারণে খুব উৎফুল্ল বা খুব বিষণ্নতা দেখা দেওয়া
 অসংলগ্ন কথা বলা
 দাম্পত্য কলহ আর যৌন সমস্যা
 সব সময় উৎকণ্ঠা বা অহেতুক ভীতির মধ্যে থাকে, অন্যকে সন্দেহ করে
 নিজেকে গুটিয়ে রাখা, সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়া
 বেশি বেশি হাতখরচের টাকাপয়সা চাওয়া, দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়া
 ঘন ঘন মুঠোফোনের নম্বর পাল্টানো
 অনেক সময় অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় ঘরে ফেরা
 ঘরে মাদক গ্রহণের উপকরণ (সিগারেটের রাংতা, ট্যাবলেটের স্ট্রিপ, দেশলাই ইত্যাদি) পাওয়া
 বাসার দামি জিনিসপত্র হারিয়ে যেতে থাকা
 স্বাস্থ্য ভেঙে পড়া এবং খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম
 বাথরুমে বেশি সময় কাটানো
 নতুন (আসক্ত) বন্ধুবান্ধব হওয়া ও পুরোনো ভালো বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা
 ঘুম ঘুম ভাব বা অস্থিরতা বোধ করা
 হাত-পায়ের শিরায় সুচ ফোটানোর দাগ
 প্রায়ই রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা ঘটানো বা মারামারিতে জড়িয়ে পড়া
 অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজকর্মে লিপ্ত হওয়া

মাদকাসক্তি প্রতিরোধে ও চিকিৎসায় পরিবারের করণীয়
 সন্তানকে বুঝতে শিখুন। তার ভালো লাগা মন্দ লাগাকে গুরুত্ব দিন। সন্তানের সঙ্গে গুণগত সময় কাটান
 পারিবারিক সম্প্রীতি আর সৌহার্দ্য বজায় রাখুন। পরিবারকে সব আনন্দের কেন্দ্রে পরিণত করুন। একসঙ্গে ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবার খান, বেড়াতে যান আর ক্যারম-লুডুর মতো ঘরোয়া খেলা খেলুন। দাম্পত্য কলহ এড়িয়ে চলুন।
 সন্তানকে অহেতুক সন্দেহ করবেন না। তাকে কটাক্ষÿকরবেন না, কারও সঙ্গে তুলনা করবেন না।
 নিজে সন্তানের বন্ধু হোন। মাদক, মাদকাসক্তি এবং এর পরিণতি নিয়ে তার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন—এ বিষয়ে তার মতামত মন দিয়ে শুনুন।
 খেলাধুলা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করুন।
 গোপন নজরদারি করবেন না, সন্তানকে না জানিয়ে তার ব্যক্তিগত দ্রব্যাদি দেখার চেষ্টা করবেন না।
 মোবাইল ফোনের অযৌক্তিক আর বেশি ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করুন।
 সন্তানের বন্ধু কারা, সে কাদের সঙ্গে মিশছে তা সরাসরি জানার চেষ্টা করুন।
 সন্তানের রাত জাগা ও দিনে ঘুমানোকে নিরুৎসাহিত করুন।
 বাইরে বা রেস্তোরাঁতে সে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে চাইলে তাকে বাসায় বন্ধুদের ডেকে আড্ডা দিতে উৎসাহিত করুন।
 হাতখরচ হিসেবে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
 অভিভাবকেরা যেকোনো ধরনের মাদক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন, পারিবারিক জীবনে নৈতিকতার চর্চা করুন।
 মাদকাসক্তির বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকেরা একে অপরের কাছে বা চিকিৎসকের কাছে কোনো মিথ্যা বলবেন না।
 মাদকাসক্তি একটি রোগ—তাই আসক্তকে রোগী হিসেবে দেখুন, তাকে দোষারোপ করবেন না।
 মাদকমুক্ত হবে ভেবে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া বা বিয়ে দেওয়ার মতো ভুল পদক্ষেপ কখনোই নেবেন না। চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার পর বিদেশে পাঠান বা বিয়ের ব্যবস্থা করুন।
 আপনজন মাদকে জড়িয়ে পড়লে তাকে ঘৃণা, বিদ্রূপ না করে, দূরে সরিয়ে না দিয়ে বুকে টেনে নিন। বক্রোক্তি করবেন না, তাকে ত্যাগ করবেন না, চিকিৎসার উদ্যোগ নিন।
 আপনজনদের মধ্যে মাদকাসক্তির লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত মনোচিকিৎসকেরা শরণাপন্ন হোন, লক্ষণগুলো আড়াল করবেন না।
 নিজে নৈরাশ্যবাদী হবেন না এবং আরেকজনকেও নিরাশ করবেন না। মাদকাসক্তি একটি রোগ, এর বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা আছে।
 চিকিৎসা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়বেন না, প্রিয়জনকে অপচিকিৎসা থেকে দূরে রাখুন। প্রয়োজনে সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগাযোগ করুন।
 মাদকাসক্তি রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি এবং এর কয়েকটি ধাপ রয়েছে, বিষয়টি মাথায় রেখে ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করান এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন।
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।