একদল চলচ্চিত্রপ্রেমীর গল্প

ফেসবুকে চলচ্চিত্র অনুরাগীদের দুটি গ্রুপের পাঁচ সদস্য । ছবি: আশরাফুল আলম
ফেসবুকে চলচ্চিত্র অনুরাগীদের দুটি গ্রুপের পাঁচ সদস্য । ছবি: আশরাফুল আলম
>ফেসবুকে তরুণ চলচ্চিত্র অনুরাগীদের কিছু গ্রুপ রয়েছে। গ্রুপের সদস্যরা দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র দেখেন, পর্যালোচনা লেখেন, অন্যের লেখায় গঠনমূলক আলোচনা করেন, বাংলা চলচ্চিত্রের সুদিনের প্রত্যাশা করেন। পরিচিত হওয়া যাক তাঁদের কাজের সঙ্গে।

‘বাংলা চলচ্চিত্র’, ‘মুভি লাভারস পোলাপাইন’, ‘মুভি অ্যান্ড সিরিজ অ্যাডিক্টেড’, ‘সিনেমাখোরদের আড্ডা’ কিংবা ‘মুভি লাভারস অব বাংলাদেশ’ নামগুলো একেকটি ফেসবুক গ্রুপের। কোনো কোনো গ্রুপের সদস্যসংখ্যা দেখে অবাক হতে হলো—দুই লাখ, চার লাখ, ছয় লাখ; কোনোটা তো আরও বেশি। এই গ্রুপগুলো পরিচালনা তো বটেই, এর সদস্যরাও বেশির ভাগ তরুণ। তাঁদের পরিচয় চলচ্চিত্রপ্রেমী।

এমন একটি গ্রুপে যোগ দিতেই সেদিন অনুমতি চেয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় দুটি প্রশ্ন ভেসে এল, ‘আপনার প্রিয় চলচ্চিত্রের নাম কী? আপনি কি এই গ্রুপের নিয়মকানুন মেনে চলতে একমত?’ জুতসই উত্তর দেওয়া হলো। কিন্তু গ্রুপ প্রশাসকের অনুমতি পেতে সেদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল অনেকটা সময়। কেন?

৬ সেপ্টেম্বর যখন ‘সিনেমাখোরদের আড্ডা’ ও ‘মুভি লাভারস অব বাংলাদেশ’ গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হলো, এই ‘কেন-ই’ সামনে এনেছিলাম। মুভি লাভারস অব বাংলাদেশের ফরহাদ হোসেন বললেন, ‘প্রতিটি গ্রুপেই এমন কিছু প্রশ্ন রাখা হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে নতুন একজন মানুষ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। আর অনুমোদন দিতে দেরি হওয়ার কারণ, আমরা ব্যক্তিটি কোন মতাদর্শের তাঁর প্রোফাইল ঘেঁটে দেখার চেষ্টা করি, এ ছাড়া প্রশাসকদের ব্যস্ততার জন্যও দেরি হতে পারে।’

সেদিন আমাদের আমন্ত্রণে দুটি গ্রুপের কাউসার রুশো, তাসনিম সায়লা, ফরহাদ হোসেন, ফয়সাল মজিদ ও অন্বয় আকিব অনেকটা গ্রুপগুলোর প্রতিনিধি হয়েই এসেছিলেন। তাঁদের কাছেই জানা গেল চলচ্চিত্রপ্রেমী তরুণদের এগিয়ে চলার গল্প।

সিনেমা নিয়ে এমন ফেসবুক গ্রুপে চলে চলচ্চিত্র–চর্চা
সিনেমা নিয়ে এমন ফেসবুক গ্রুপে চলে চলচ্চিত্র–চর্চা

সমমনাদের সম্মিলন

সিনেমাখোরদের আড্ডা নামের গ্রুপটি যাত্রা শুরু করে ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে। মূলত সামহোয়ারইনব্লগে সিনেমা নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করতেন, তাঁরাই একদিন সবাই মিলে সামনাসামনি আড্ডা দিতে চাইলেন। যোগাযোগের সুবিধার জন্য পুশকিন নামে একজন ব্লগার ফেসবুকে গ্রুপটি খোলেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন কাউসার রুশো। এর পরপরই ব্লগের অনেক জনপ্রিয় সিনেলেখকেরা যোগদান করেন, যাঁদের মধ্যে অনেকেই এই গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন। রুশো ছাড়াও গ্রুপটির বর্তমান অ্যাডমিন প্যানেলে আছেন সুদীপ মজুমদার ও স্নিগ্ধ রহমান। কাউসার রুশো বলছিলেন, প্রতিটি গ্রুপ শুরুর গল্প প্রায় এমনই। সমমনা মানুষেরা শুরু করেন। একে একে যোগ দিতে থাকেন তাঁদের মতোই কিংবা কাছাকাছি ভাবতে পারা মানুষেরা।

দর্শক যখন লেখক

‘সিনেমা দেখে অনেক প্রতিক্রিয়া হয়। বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে। নিজের ভাষাতেই অন্যের সঙ্গে নিজের ভালো লাগা-মন্দ লাগা ভাগাভাগি করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোথায় লিখব?’ তাসনিম সায়লার মতো এমন প্রশ্ন যাঁদের মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে, তাঁদেরই কেউ কেউ এই গ্রুপগুলোর উদ্যোক্তা। এখানে দর্শকই লেখক। নিজেরা চলচ্চিত্র দেখেন, সূক্ষ্ম অনুভূতির কথা অবলীলায় লেখেন। তাই হয়তো গ্রুপগুলো এত জনপ্রিয়। যেমনটি দেখা গেল ৬ সেপ্টেম্বর। সেদিন ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহর মৃত্যুদিন। গ্রুপগুলোতে তাঁকে নিয়েই অসংখ্য পোস্ট নজরে এল। প্রিয় নায়কের ফ্যাশন, অভিনীত ছবি, তাঁকে দেখা-না দেখার অনুভূতি ভক্তরা নিঃসংকোচে লিখেছেন।

ইচ্ছেমতো মত প্রকাশ

মতামতের জন্য গ্রুপগুলো উন্মুক্ত। কোনো চলচ্চিত্র, অভিনেতা-অভিনেত্রী কিংবা সিনেমার কারিগরি বিষয় নিয়ে দর্শক তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অবলীলায় লিখতে পারেন। অন্যের লেখায় নিজের মতামত দিতে পারেন। অন্বয় আকিব বলছিলেন, এ জন্যই গ্রুপগুলো মানুষের কাছে জনপ্রিয়। তবে কিছু সাধারণ নির্দেশনা অনুসরণ করে প্রতিটি গ্রুপই। যেমন কোনো ব্যক্তিত্ব, ধর্ম, বর্ণ নিয়ে আঘাত করলে তাঁকে গ্রুপ থেকে বের করে দেওয়া হয়। কারও লেখায় মতামত দিতে গিয়ে কটূক্তি করলে একই শাস্তি দেওয়া হয়।’ তখন কাউসার রুশো বললেন, ‘সবারই সমান অধিকার বলে আমরা নির্দেশনাকে নীতিমালা বলি না, এই নির্দেশনাকে বলি “সাদাসিধে কথা।”’

রিভিউ লেখেন বাংলায়

ইংরেজি ভাষার কোনো ছবি সম্পর্কে খুঁজলে ইন্টারনেটে হয়তো হাজারটা রিভিউ পাওয়া যাবে। কিন্তু বাংলা রিভিউ কি পাওয়া যায়? এই তরুণদের নিরন্তর চেষ্টা মাতৃভাষা বাংলায় রিভিউ লেখার সংস্কৃতি তৈরি করার। মুভি লাভারস পোলাপাইন নামের গ্রুপটি যেমনটি নিজেদের সম্পর্কে এমন কথাই লিখেছে। তারা বলেছে, ‘বাংলা ভাষাকে একটু সমৃদ্ধ করতে চাই। তাই যেকোনো মুভি দেখলেই ছোট হোক, বড় হোক, ভালো হোক, খারাপ হোক, একটা রিভিউ লিখে ফেলুন, অবশ্যই বাংলায়।’

লেখক থেকেই অ্যাডমিন

মুভি লাভারস অব বাংলাদেশ গ্রুপের মডারেটরদের একজন ফয়সাল মজিদ। গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে স্নাতক পড়ছেন। দক্ষিণ ভারতের মালয়ালাম চলচ্চিত্রের পোকা। কখন কোন ছবি আসছে, নতুন কোনো ছবির অভিনয়শিল্পী থেকে ক্যামেরাম্যানের তথ্যও তাঁর কাছে পাওয়া যায়। এসবই লেখেন তাঁদের গ্রুপে। লিখতে লিখতেই পরিচয় হয় তাসনিম সায়লাদের সঙ্গে। এখন গ্রুপের দলনেতাদের একজন। তাসনিম সায়লা বলছিলেন, লিখতে লিখতেই অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। এভাবেই গ্রুপের দায়িত্বে আসেন কেউ কেউ। এই সদস্যরা ছড়িয়ে আছেন সারা দেশে।

বাংলাদেশের পতাকা হাতে

বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য ভিন্ন অনুভূতি রয়েছে সদস্যদের। কোনো বাংলা সিনেমা মুক্তির সময় আলোচনাতেও এগিয়ে গ্রুপের সদস্যরা। কাউসার রুশো বলছিলেন, ‘আমরা বরাবরই বাংলা চলচ্চিত্রকে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করি। নতুন শর্ট ফিল্ম যাঁরা বানাচ্ছেন তাঁদের উৎসাহ দিই, বাংলা সাবটাইটেল যোগ করেন যাঁরা তাঁদেরকেও সহায়তা করি।’ শুধু এই কাজই নয়, গ্রুপগুলো পাইরেসি আর চলচ্চিত্রের ডাউনলোড লিংক শেয়ারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে আসছে। গ্রুপের নিয়মাবলিতেই এই কথাগুলো উল্লেখ করা আছে।

ব্যতিক্রমী এই তরুণদের কথা শুনতে শুনতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। চলচ্চিত্র অনুরাগী তরুণদের যেন গল্পের শেষ নেই। সে গল্পে মিশে থাকল—মজার সব অভিজ্ঞতা আর বাংলা চলচ্চিত্রের প্রতি এই তরুণদের অগাধ ভালোবাসা।