সাধারণের অসাধারণ সাহস

সুমন হোসেন ও শাহনাজ পারভীন—চলনবিলে নৌকাডুবির পর ১৭ জনকে উদ্ধার করেছেন এই দুই সাহসী। ছবি: হাসান মাহমুদ
সুমন হোসেন ও শাহনাজ পারভীন—চলনবিলে নৌকাডুবির পর ১৭ জনকে উদ্ধার করেছেন এই দুই সাহসী। ছবি: হাসান মাহমুদ
দুর্ঘটনা ঘটলে প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মীরা ছুটে আসেন; তবে সবার আগে আসেন আশপাশের সাধারণ মানুষ। নিজেদের জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন উদ্ধারকাজে। সম্প্রতি চলনবিল অঞ্চল ও সরাইলের দুটি দুর্ঘটনায় কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে বাঁচিয়েছেন অনেক মানুষের প্রাণ। এই সাহসীদের কথা নিয়েই এবারের প্রতিবেদন।

চলনবিলের দুই সাহসী

দুর্ঘটনাস্থলের পাশেই এক ডিঙিতে বসে ছিল বালক সুমন, অন্যদিকে বাড়িতে শাহনাজ পারভীন কাজ করছিলেন গেরস্থালির। সাঁতার না জানা মানুষের বাঁচার আকুতি শুনে ছুটে গিয়েছিলেন এই দুজন। মাঝদরিয়া থেকে নানা কৌশলে তাঁরা বাঁচিয়েছেন ১৭ জনকে।

সরোয়ার মোর্শেদ, পাবনা

পাইকপাড়া গ্রামটি ছবির মতো। অনেকে আবার আদর করে বলেন চলনবিলের সখী। গ্রামের সামনেই বিস্তৃত চলনবিল। এই বিল ধরে ভ্রমণপিয়াসী মানুষের আনাগোনা দেখা যায় প্রায়ই। সেদিনও একদল মানুষ নৌকায় ঘুরতে এসেছিলেন। বিলের সৌন্দর্য উপভোগে মগ্ন যাত্রীরা নৌকার ছইয়ে উঠে ছবি তুলছিলেন, মেতেছিলেন হাসি-আনন্দে।

১৩ বছরের সুমন হোসেনও আনন্দের ভাগী হয়েছিল সেদিন। কিছুটা দূরত্ব রেখে নিজের ডিঙি বেয়ে সঙ্গ নিয়েছিল সুমন। বিকেলটা ভালোই কাটছিল তার। সুমনের বর্ণনায় ফিরে এল সেই ক্ষণ। আমাদের চোখেও ভেসে উঠল পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রাম।

৩১ আগস্ট। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। দিনের শেষ আলোয় দলেবলে ছবি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নৌকার আরোহীরা। কাছাকাছি একটি ডিঙিতে বসে তা দেখছিল সুমন। নৌকার যাত্রীরা একে একে ছইয়ের ওপর ওঠেন সেলফি তুলতে। সবাই ওপরে এক পাশে উঠলে হেলে যায় নৌকাটি। হুড়মুড় করে ভেঙে যায় ছই। মুহূর্তেই ডুবতে শুরু করে নৌকা।

সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সুমন হোসেনই ছুটে গিয়েছিল ডুবন্ত মানুষের কাছে
সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সুমন হোসেনই ছুটে গিয়েছিল ডুবন্ত মানুষের কাছে

সুমন ছুটল নৌকা নিয়ে
ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল সুমন। সে দেখছিল অনেকে সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। সাহায্যের জন্য ডাকছে তাকে। বয়সের তুলনায় সাহসী হলেও ডুবতে বসা মানুষের বাঁচার আকুতি আর আর্তচিৎকারে বালক সুমনের মনে ভয় ধরিয়ে দিল। কিন্তু সে ভয় স্থায়ী হয়নি। মুহূর্তেই সাহস সঞ্চার হলো। সুমন ছুটে গেল দুর্ঘটনায় পড়া নৌকার পানে। আনন্দোচ্ছ্বাস কীভাবে বিষাদে ভরে ওঠে, তার নীরব সাক্ষী হলো সুমন।

শাহনাজ শুনছিলেন চিৎকার
বিল থেকে হাঁসগুলো বাড়ি ফিরেছে। শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে বাড়ির উঠানে তখন হাঁসদের খাবার দিচ্ছিলেন গৃহিণী শাহনাজ পারভীন। ৩৫ বছর বয়সী শাহনাজের হঠাৎ কানে এল ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ চিৎকার। বিলের দিকে তাকিয়ে দেখেন দুর্ঘটনার দৃশ্য। ছই ভেঙে ডুবে যাচ্ছিল নৌকা। বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন অনেকে। বাড়ির পাশেই পাড়ে বাঁধা নৌকা নিয়ে নেমে পড়েন শাহনাজ। ছুটে যান দুর্ঘটনাস্থলে।

শাহনাজ পারভীন ও সুমন হোসেনের সাহসিকতার গল্প এখন গ্রামের মানুষের মুখে মুখে
শাহনাজ পারভীন ও সুমন হোসেনের সাহসিকতার গল্প এখন গ্রামের মানুষের মুখে মুখে

বাঁচল ১৭ প্রাণ
সুমন ও শাহনাজ প্রায় একই সময়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছান। দেখলেন সাঁতার না জানা মানুষেরা বাঁচার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শাহনাজ তাঁর ডিঙিতে দুজন তোলার পরই নৌকাটি টলতে শুরু করল। তিনি বলছিলেন, ‘বুঝতে পারছিলাম, দেরি হলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। মানুষগুলোকে একসঙ্গে নিতে গেলে আর বাঁচানো যাবে না।’ সুমনের নৌকাটি শাহনাজের নৌকার তুলনায় খানিকটা বড় হলেও পাঁচজনের বেশি নেওয়া যাবে না। কিন্তু সবাইকে তো পাড়ে নিতে হবে।

বুদ্ধিটা এল সুমনের মাথায়। সবাইকে যেহেতু নৌকায় তোলার কায়দা নেই, তাই সে বলল, পানিতে ভেসে নৌকা ধরে রাখতে। এভাবেই কৌশল খাটিয়ে ১৭ যাত্রীকে উদ্ধার করলেন সুমন ও শাহনাজ পারভীন।

শাহনাজ পারভীন জানালেন, ‘সুমনের কৌশলেই সেদিন বেঁচেছিল মানুষ। সে কাউকে নৌকায় উঠতে দিচ্ছিল না। সবাইকে বলছিল নৌকা ধরে ভেসে থাকতে। পরে আমিও তা-ই করি।’

নিখোঁজ মানুষের খোঁজে ফায়ার সার্ভিসের অভিযান, সঙ্গে যোগ দিয়েছেন গ্রামবাসীরাও
নিখোঁজ মানুষের খোঁজে ফায়ার সার্ভিসের অভিযান, সঙ্গে যোগ দিয়েছেন গ্রামবাসীরাও

যাত্রী ছিলেন ২২ জন
১৭ জন উদ্ধারের পর আর কাউকে খুঁজে পাননি দুজন। ততক্ষণে এগিয়ে আসেন গ্রামের অন্যরা। তীরে ভেড়া যাত্রীদের কয়েকজন তখন অসুস্থ। এক শিশু চিৎকার করছিল বাবা-মায়ের খোঁজে। সবাই মিলে শান্ত করেন তাদের। চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন অসুস্থদের। তখন বুঝতে পারেন আরও কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছে। খুঁজতে শুরু করেন নিখোঁজ যাত্রীদের। কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়নি আর কাউকে। ততক্ষণে জানাজানি হয়ে যায়, ২ জন মাঝিসহ যাত্রী ছিল ২২ জন। ঘটনার পরপরই মাঝি দুজন সাঁতরে পাড়ে উঠে চলে যান। তখন ডাকা হয় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। টানা দুই দিন চেষ্টা চালিয়ে ফায়ার সার্ভিসের রাজশাহী বিভাগীয় ডুবুরি দল পাঁচজনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। প্রাণ হারানো পাঁচজন হলেন ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী শাহনাজ পারভিন, ঈশ্বরদী ডাল গবেষণা ও আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক সহকারী বিল্লাল গণি ও তাঁর স্ত্রী মমতাজ পারভিন এবং ঈশ্বরদী সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদের ক্রীড়া সম্পাদক রফিকুল ইসলাম স্বপন বিশ্বাস ও তাঁর ৯ বছর বয়সী মেয়ে সওদা মণি।

বেঁচে ফেরা মানুষেরা কৃতজ্ঞ
সুমন ও শাহনাজের প্রতি কৃতজ্ঞ বেঁচে ফেরা যাত্রীরা। এই যাত্রীদেরই একজন মোশাররফ হোসেন। সেদিনের দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন। তবে রক্ষা পেয়েছেন কন্যাসহ তিনি এবং তাঁর এক ভাগনে। তিনি জানালেন, কুষ্টিয়া ও ঈশ্বরদীতে থাকা বন্ধু-স্বজন মিলে তাঁরা কয়েকটি পরিবার নৌভ্রমণে বেরিয়েছিল। নৌকাটি ভাঙ্গুড়া উপজেলার বড়াল ব্রিজ এলাকা থেকে ছেড়ে চলনবিল দিয়ে পাইকপাড়া পৌঁছালে দুর্ঘটনায় পড়ে। মুহূর্তেই ডুবে যায়।

গৃহিণী শাহনাজ পারভীন কি অসাধারণ কাজটিই না করেছেন
গৃহিণী শাহনাজ পারভীন কি অসাধারণ কাজটিই না করেছেন

গ্রামে তাঁরা বীর
৫ সেপ্টেম্বর হাজির হয়েছিলাম হান্ডিয়াল দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে সুমন। স্কুলে সে এখন রীতিমতো নায়ক। বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকে দেখতে আসছে তাকে। কথা বলছে। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা শুনছে। শুধু গ্রামেই বলছি কেন, সুমনের এই কৃতিত্বের কথা পাবনার জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন নিজেও তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে প্রশংসা করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক বলছিলেন, ‘সুমন স্বেচ্ছাশ্রমের একজন বীর। সঙ্গে শাহনাজ পারভীনসহ গ্রামের প্রত্যেক মানুষের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁরা এগিয়ে এসে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন, এ জন্যই হয়তো এতগুলো প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। তাঁদের এই পদক্ষেপ স্মরণ করে সবাই সবার বিপদে হাত বাড়াবে বলে আশা রাখি।’

সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ পাবনার জেলা প্রশাসক ১ সেপ্টেম্বর বিকেলে সুমনের সঙ্গে দেখা করে তার পড়ালেখার জন্য ৫ হাজার টাকা উপহার দেন।
গৃহবধূ শাহনাজ পারভীনও অনেকের বাহবা পাচ্ছেন। তাঁর স্বামী আশরাফ আলী কৃষিশ্রমিক। সুমন ও শাহনাজ পারভীনের বেড়ে ওঠা চলনবিলের পানিতে সাঁতার কেটে। নৌকা চালিয়ে দিনের কাজ করতে হয়। তাই সাহসটা একটু বেশি। সে সাহস আর মানবিক মনের জোরেই বেঁচে গেছে ১৭ জনের প্রাণ।