প্রবীণদের আধুনিক আবাস

প্রবীণদের সার্বিক যত্ন নেওয়ার জন্যই সদা প্রস্তুত থাকেন কর্মীরা
প্রবীণদের সার্বিক যত্ন নেওয়ার জন্যই সদা প্রস্তুত থাকেন কর্মীরা

দুপুরের খাবার খেয়ে চেয়ারে বসে ছিলেন। দরজাটা খোলা বলে কড়া নাড়তে হলো না। প্রবেশের অনুমতি চাইতেই মুখে হাসি ফুটিয়ে পাশের খালি চেয়ারটা দেখিয়ে ইশারায় বললেন, ‘বসো।’ বসতে গিয়েই চোখে পড়ল, তাঁর হাতের কাছে পুরোনো কিছু রিডার্স ডাইজেস্ট, আছে বিভিন্ন লেখকের কয়েকটি ইংরেজি বইও। চট্টগ্রামে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রধান ছিলেন রোকেয়া কামাল; শিক্ষকের দৃষ্টি বলে কথা, মনের প্রশ্নটা বুঝে নিলেন। নিজে থেকেই বললেন, ‘রিডার্স ডাইজেস্ট আমার পছন্দের ম্যাগাজিন। খুব ভালো ভালো লেখা ছাপে ওরা।’

রোকেয়া কামাল চতুর্থ তলার ৩০৫ নম্বর কক্ষটিতে থাকেন। অপরাজিতা নামের এই কক্ষটিই এখন তাঁর ঠিকানা। রাজধানীর শ্যামলীর হলিলেন সড়কের এই ভবনটি সংকটগ্রস্ত, বিশেষ ব্যক্তি ও প্রবীণদের বসবাসের জন্য। সুবার্তা ট্রাস্টের এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত আছে আবাসন নির্মাণপ্রতিষ্ঠান দ্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এসইএল)।

প্রবীণ ও বিশেষ মানুষদের নিয়ে এই উদ্যোগের শুরুর পর থেকেই রোকেয়া কামাল এখানে আছেন। প্রয়াত স্বামী সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। ছেলেমেয়ে দুজনই প্রবাসী। ছেলে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে, মেয়ে নিউজিল্যান্ডে। চোখের চশমাটা হাতে নিয়ে রোকেয়া কামাল বলছিলেন, ‘সবাই তো যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। একটা সময় মনে হলো, আমি কেন ওদের বোঝা হতে যাব। নিজের জন্য একটি নিরাপদ জায়গা দরকার।’ এরপর তিনি যোগাযোগ করেন সুবার্তা ট্রাস্টের সঙ্গে। তারা দেখভালের দায়িত্ব নেয় তাঁর। রোকেয়া কামাল বলছিলেন, ‘খুব ভালো আছি এখানে। মেয়ে এসে প্রায় ছয় মাস আমার সঙ্গে থেকে গেল। আমিও সুস্থ থাকতে ওদের ওখানে যেতাম। ভালোই কাটছে সব মিলে।’

 দিন কাটে যত্নে

১৬ জন নারী-পুরুষের বাস এই বাড়িতে। কেউ সাবেক অধ্যাপক, কেউ ব্যারিস্টার, কেউ সরকারের সচিব ও বেসরকারি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাঁদের দেখভাল করার জন্য আছেন সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা।

সুবার্তা ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক শেলিনা আক্তার বললেন, ‘কয়েকজন প্রবীণ মানুষ একসঙ্গে বসবাস করলেই আমরা বুঝি বৃদ্ধাশ্রম হিসেবে, কিন্তু এই বাড়িটি তা নয়। যেকোনো বয়সের মানুষই সেবাপ্রাপ্তির জন্য এখানকার কক্ষ ভাড়া নিতে পারেন কিংবা বসবাস–ব্যবস্থাটি কিনে নিতে পারেন।’

তারও কিছু প্রমাণ মিলল ভবনের ঘরগুলো ঘুরে দেখে। বাসিন্দারা তখন কেউ ভাতঘুমে, কেউ টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখেছেন। একজনকে পাওয়া গেল সুবার্তা ট্রাস্টের দপ্তরে। ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজ করছিলেন। নিজের নাম প্রকাশ করলেন না। জানালেন, একাকী জীবন কাটিয়েছেন। শেষ বয়সে এই আবাসনব্যবস্থাকেই বেছে নিয়েছেন।

প্রবীণ ও সংকটগ্রস্ত মানুষের জন্য এসইএল ছায়াবীথি ভবনটি সুবার্তা ট্রাস্ট বলে ‘স্বপ্নলোক পিস ভ্যালি’। গিয়েছিলাম এক দুপুরে। আটতলা ভবনের নিচতলায় রয়েছে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। দ্বিতীয় তলায় চিকিৎসকের কক্ষ, প্রশস্ত বসার ও খাবার ঘর, ব্যায়ামাগার, গ্রন্থাগার, রান্নাঘর এবং সুবার্তার কর্মী ও দাপ্তরিক কাজের জন্য ঘর। তৃতীয় থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত প্রতি তলায় পাঁচটি করে ফ্ল্যাট। এক-দুজনের বসবাসের জন্য আধুনিক সুবিধা রয়েছে ফ্ল্যাটগুলোতে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম তলার কক্ষগুলোর সঙ্গে আলাদা রান্নাঘর। লিফটেই ওঠা যায় ছাদে। ফুলের বাগানের পাশে বসে বিকেলের রোদ গায়ে মেখে ভবনের বাসিন্দারা সময় কাটান। এসইএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল বললেন, ‘অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছ থেকে শুনলাম সুবার্তা ট্রাস্টের কথা। পরে ট্রাস্টের উদ্যোগ সম্পর্কে জানলাম। আমার ভালো লাগল। তাদের সঙ্গে যুক্ত হলাম। সুবার্তার সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ভবন নির্মাণ করা হলো।’ তিনি জানালেন, এই ভবনে এসইএলের অংশের ফ্ল্যাটগুলো যে কেউ কিনতে পারবেন। তবে বসবাস করতে হলে সুবার্তা ট্রাস্টের নিয়মনীতি অনুসরণ করে চলতে হবে।

আধুনিক সুযোগ–সুবিধা রয়েছে ভবনের বাসিন্দাদের জন্য
আধুনিক সুযোগ–সুবিধা রয়েছে ভবনের বাসিন্দাদের জন্য

প্রয়োজন বুঝে সেবা

এখানকার বাসিন্দাদের জন্য রয়েছে সমন্বিত সেবা, অর্থাৎ একজন মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয় এবং রোজকার যত্ন-আত্তি নেওয়া হয়, তা-ই সমন্বিত সেবা। শেলিনা আক্তার বলছিলেন, ‘শুধু চিকিৎসাতেই মানুষের সুস্থতা নিশ্চিত হয় না, প্রয়োজন সঠিক সেবার, গভীর পর্যবেক্ষণের। মানুষ যখন প্রবীণ হন, তখন তাঁর জন্য সেবার ধরন আলাদা হওয়ার পাশাপাশি তা বেড়েও যায়। আর সংকটাপন্ন মানুষ হন অসহায়। তখন তাঁদের স্নেহ, ভালোবাসা আর যত্নের প্রয়োজন হয়।’

এই কাজই করে থাকেন সুবার্তা ট্রাস্টের প্রশিক্ষিত কর্মীরা। মাসিক ২০ হাজার টাকা থেকে এখানে সেবা ব্যয় শুরু হয়েছে। সেবাগ্রহীতার শারীরিক-মানসিক অবস্থা এবং প্রয়োজনীয়তার ওপর বাড়তি অর্থ যোগ হয়। শেলিনা আক্তার জানালেন, এখানে সেবাগুলো কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে—সাধারণ সেবা, বিশেষ সেবা, সংকটকালীন সেবা, উন্মুক্ত সেবা, জরুরি সেবা ও প্যাকেজ-বহির্ভূত সেবা। একজন সুস্থ প্রবীণ ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজনগুলো সাধারণ সেবার অন্তর্ভুক্ত। যাঁরা নিজেদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো অন্যের সাহায্য ছাড়া করতে পারেন না বা কোনো বিশেষ পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন, তাঁদের জন্যই বিশেষ সেবা প্যাকেজ। আবার কোনো প্রৌঢ় ব্যক্তি যদি শয্যাশায়ী হন, তাঁর যত্ন নেওয়ার জন্য দিনরাত একজন সেবাদাত্রী প্রয়োজন হয়। এটি সংকটকালীন সেবা। এমন প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো মাথায় রেখেই সেবাগুলো বিন্যস্ত করা হয়েছে।

ব্যস্ত নগরীতে দৈনন্দিন কাজের চাপে অনেক সন্তান ইচ্ছা থাকলেও প্রবীণ মা-বাবার পরিচর্যার সুযোগ পান না। আবার কেউ কেউ নিজের প্রয়োজনে বিদেশে পাড়ি জমালে দেশে মা-বাবার যত্ন নেওয়ার কেউ থাকে না। আবার কোনো কোনো প্রবীণ আছেন, যাঁরা সন্তান ও সমাজের কাছে নানা কারণে উপেক্ষিত। এমন প্রবীণদের সার্বিক যত্ন নেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থাপনা। একে আধুনিক জীবনযাপনে নতুনতর ধারণাই বলা যায়। সফল হোক সুবার্তা ট্রাস্ট এবং এসইএলের উদ্যোগ।