সিটি গোল্ডের গ্রাম

>নগরের বিভিন্ন গয়নার দোকানে যে ইমিটেশন বা প্লেটেড কানের দুল পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই তৈরি হয় ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায়। এই উপজেলার গ্রামে গ্রামে ছোট-বড় কারখানায় চলে গয়না তৈরির কর্মযজ্ঞ।
গয়নায় নকশা আঁকার কাজ।
গয়নায় নকশা আঁকার কাজ।

পিঁড়ির ওপর রাখা পাথুরে ছাঁচে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাঁর। গয়না কারিগরের এক হাতে চিমটা আর অন্য হাতে গ্যাস টর্চ। একমনে ব্রোঞ্জের তরল ছাঁচে ফেলছিলেন। সেখানে তৈরি করা গয়না রাখছিলেন পাশেই। তাঁর পাশের নারী কানের দুলগুলো পরখ করে দেখলেন, ঠিক আছে তো! একসময় কানের দুলগুলো নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে। সেখানেই ব্রোঞ্জের তৈরি অলংকারগুলো ডোবানো হলো তরল রাসায়নিকে। তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেসব অলংকারই সোনালি রং ধারণ করল। আরও এক পর্ব পালিশের পর জ্বলজ্বল করতে থাকল সোনার অলংকারের মতো।

গয়না তৈরির এমন দৃশ্য ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলা সদরে এক কারখানায় দেখছিলাম। শুধু এই কারখানা নয়, উপজেলার অনেক বাড়িতেই আছে এমন গয়না তৈরির কারখানা। মহেশপুরে এসব কারখানায় প্রতিদিন শুধু কানের দুলই তৈরি হয় লক্ষাধিক জোড়া। তার সঙ্গে এখানকার কারিগরেরা তামা, পিতল আর ব্রোঞ্জের তৈরি চুড়ি, গলার হার, হাতের বালাসহ নারীদের ব্যবহৃত নানা রকম গয়নাও বানান। পাড়াগাঁয়ে তৈরি হওয়া কম মূল্যের এই অলংকারই হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে দেশের সব জেলায়। এসব ইমিটেশন বা প্লেটিং করা গয়নাই ‘সিটি গোল্ড’ নামে পরিচিত।

গয়নায় নকশা আঁকার কাজ।
গয়নায় নকশা আঁকার কাজ।

 মিলন সিটি গোল্ডে গোড়াপত্তন

কাঠের পিঁড়িতে বসে কানের দুলের ছড়াগুলো আপন মনে ধাতব তারে বাঁধছিলেন আবদুল হামিদ। সামনেই প্লাস্টিকের লাল বালতি। সে বালতি ভরা রাসায়নিক তরল। এই তরলেই কায়দা করে সেগুলো রাখছিলেন। কাজের ফাঁকেই তিনি ফিরে গেলেন মহেশপুরে ইমিটেশন গয়না তৈরির গোড়াপত্তনের কথায়।

মহেশপুরের পুরোনো শহর এলাকায় বেশ কয়েকটি সোনার দোকান ছিল একসময়। দুই ভাই আবদুর রহিম আর আবদুল হামিদের দোকানের নাম ছিল মুসলিম জুয়েলার্স। প্রায় ১০ জন কারিগর কাজ করতেন তাঁদের দোকানে। ২০০৩ সালের দিকের কথা। এক লাফে সোনার দাম প্রায় তিন গুণ বেড়ে যায়। আবদুল হামিদ বলছিলেন, ‘উপজেলায় দরিদ্র মানুষের বসবাস। সোনার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমাদের জুয়েলারি দোকানে বিক্রি কমতে থাকে। সফল ব্যবসাটা একসময় বন্ধই হতে যাচ্ছিল।’

শহরের দোকানে সিটি গোল্ডের গয়নার বড় চালান আসে মহেশপুর থেকে। ছবি: খালেদ সরকার।
শহরের দোকানে সিটি গোল্ডের গয়নার বড় চালান আসে মহেশপুর থেকে। ছবি: খালেদ সরকার।

ঠিক সেই সময় দুই ভাই মিলে শুরু করেন সিটি গোল্ডের ব্যবসা। মহেশপুর ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা। আবদুল হামিদ বলছিলেন, ‘পাশের দেশ ভারতে কিছু এলাকায় সিটি গোল্ডের প্রচলন ছিল। সেখান থেকেই আমি এই অলংকার তৈরির ধারণা পাই।’

২০০৩ সালে প্রথমে একটি ভাড়া ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন কারখানা। নাম দেন মিলন সিটি গোল্ড। তাঁদের আগের দোকানের ৬ জন কর্মচারীর সঙ্গে আরও ৪ জন নিয়োগ দিয়ে শুরু করেন অলংকার তৈরির কাজ। তখনো আধুনিক উপায়ে গয়না বানাতে শুরু করেননি। সে সময় বাজার থেকে ব্রোঞ্জ কিনে তার ওপর রং লাগিয়ে বানানো অলংকার বাজারে ছাড়তেন। কিন্তু তাতেই বাজিমাত। আবদুল হামিদ বলছিলেন, ‘মাত্র ৬ মাসে এই অলংকারের এতটা চাহিদা চলে আসে যে আমরা সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছিলাম।’

মহেশপুরের গ্রামে গ্রামে এ দৃশ্য পরিচিত।
মহেশপুরের গ্রামে গ্রামে এ দৃশ্য পরিচিত।

চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কারখানায় উৎপাদনও বাড়তে থাকল। কারখানার আয়তনও বৃদ্ধি পেতে থাকল।  প্রথম দিকে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ জোড়া কানের দুল তৈরি করা মিলন সিটি গোল্ড এখন প্রতিদিন ৫ হাজার জোড়া কানের দুল তৈরি করছে।

আবদুল হামিদ জানালেন, ‘আমার ভাই আগেই মারা গেছেন। ব্যবসা শুরুর সময় মাত্র ৮০০ টাকা পুঁজি ছিল, মাঠে ছিল ৫ বিঘা চাষযোগ্য জমি। এখন ব্যবসা করেই মহেশপুর শহরে ৬ তলা একটি বাড়ি করেছি। এখানেই আমাদের কারখানা। ভবনের নিচতলায় বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে।’

মহেশপুরের গ্রামে গ্রামে এ দৃশ্য পরিচিত।
মহেশপুরের গ্রামে গ্রামে এ দৃশ্য পরিচিত।

 ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে গ্রামে

মিলন সিটি গোল্ডের সাফল্যের কথা ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রতিষ্ঠানের কারিগরদের অনেকে নিজেই উদ্যোক্তা বনে যান। গড়ে তোলেন কারখানা। এভাবেই বিস্তৃত হতে থাকে উপজেলাজুড়ে। আবদুল হামিদ কথায় কথায় বলেছিলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় এক শ জন কারিগর বেরিয়ে নিজের উদ্যোগে ব্যবসা করছেন।

সেই চিত্র দেখতেই মহেশপুর উপজেলা সদর থেকে পা বাড়াই গ্রামের পথে। দুই কিলোমিটার যেতেই থামতে হলো। গ্রামের নাম জলিলপুর। সড়কঘেঁষা উঠানে মাদুর পেতে কয়েকজন নারী কাজ করছিলেন। তাঁদের সবার সামনেই ছাঁচ। ব্রোঞ্জের গয়না তুলে তুলে পরিষ্কার করছেন। তাঁদের কারও স্বামী কৃষিজীবী, কেউ যুক্ত আছেন অন্য পেশার সঙ্গে। একসময় শুধুই ঘরকন্নার কাজ করতেন। দিনে দিনে সিটি গোল্ড তৈরির কাজে এখন তাঁদেরও অংশগ্রহণ বেড়েছে।

মহেশপুরের একটি কারখানায় ইমিটেশন গয়না তৈরি করছেন কারিগরেরা।ছবি: ছুটির দিনে।
মহেশপুরের একটি কারখানায় ইমিটেশন গয়না তৈরি করছেন কারিগরেরা।ছবি: ছুটির দিনে।

জলিলপুরসহ উপজেলার নওদাপাড়া, রামচন্দ্রপুর, বামনগাছি, সেজিয়া, যাদবপুরসহ এমন আরও কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাড়ি বাড়ি তৈরি হচ্ছে এসব অলংকার। অনেকে পরিবারের সদস্যরা মিলে এই কাজ করেন। নিজেদের বাড়িতে বসেই কাজ করতে পারছেন বলে আগ্রহও বেশি। অনেকে আছেন যাঁরা বাজার থেকে ব্রোঞ্জ কিনে তৈরি করেন। এরপর ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। আবার অনেকে আছেন, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ব্রোঞ্জ নিয়ে এসে অলংকার তৈরি করে তাঁদের দিচ্ছেন।

গয়না তৈরির কাজে জড়িয়ে পড়ার গল্প বলছিলেন বেগমপুর গ্রামের সুজন হোসেন, ‘ইমিটেশন গয়না তৈরিতে যে খরচ হয়, তার দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি করা যায়। প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় হয়। গ্রামে থেকে এত ভালো রোজগার করার সুযোগ কম।’

মুনাফার চিত্র পাওয়া গেল ব্যবসায়ী রশিদুন্নবী মিলনের দেওয়া তথ্যে। তাঁর হিসাবে, এক জোড়া কানের দুল তৈরি করতে ৭ থেকে ৮ টাকা খরচ হয়। এগুলোর পাইকারি মূল্য ১০ টাকা। এই গয়নাই হাতবদল হয়ে বিভিন্ন শহরের দোকানগুলোতে ২০ টাকা দরে বিক্রি হয়। এ ছাড়া গলার চেইন ৩০ থেকে ৪০ টাকা, হাতের বালা ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি করেন তাঁরা। নকশার ভিন্নতার কারণে মূল্য কমবেশি হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।

বোঝা গেল, অল্প পুঁজিতে আয়ের এই সুযোগই মহেশপুরের মানুষদের আগ্রহী করে তুলেছে ইমিটেশন গয়না তৈরির কাজে।

শুরুটা হয়েছিল আবদুল হামিদের হাতে
শুরুটা হয়েছিল আবদুল হামিদের হাতে

হাত বদলে সারা দেশে
মহেশপুরে তৈরি এসব গয়না হাত বদল হয়ে সারা দেশে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে তৈরি গয়নার বড় অংশ যায় ঢাকায়। সেখান থেকে অন্য শহরের ব্যবসায়ীরা কিনে নেন। এ ছাড়া সরাসরি বিভিন্ন জেলার গয়না ব্যবসায়ীও এখানে এসে পাইকারি কিনে নিয়ে যান। মহেশপুর শহরের সিটি গোল্ডের ব্যবসায়ী আওলাদ হোসেন বলেন, ‘মহেশপুর এলাকায় তৈরি এই সিটি গোল্ড দেশের সব শহরেই পাওয়া যায়। মহেশপুর শহরে বর্তমানে ১৭টি কারখানা রয়েছে। একটি কারখানায় প্রতিদিন ৫ হাজার কানের দুল রং করা সম্ভব। আর গোটা উপজেলায় ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষ নিয়মিত কাজ করছেন। এ ছাড়া অনিয়মিত কিছু কারিগর রয়েছে।’
সব মিলে এক নীরব পরিবর্তন ঘটেছে মহেশপুরের গ্রামগুলোতে। এই পরিবর্তনের হাসি হাসছেন সাধারণ মানুষ। কয়েক বছর আগেও যাঁদের দিনান্তে অন্নের চিন্তা করতে হতো, তাঁরা আজ উদ্যোক্তা।