ডলফিনের মেলায়

ডলফিন নৌকা ছুটে গেছে সুন্দরবনের এ নদী থেকে ও নদীতে। ছবি: সংগৃহীত
ডলফিন নৌকা ছুটে গেছে সুন্দরবনের এ নদী থেকে ও নদীতে। ছবি: সংগৃহীত

সবার চোখ পানির দিকে। যদি দেখা যায়!

হঠাৎ ভুশ করে সত্যিই ভেসে উঠল ডলফিন। কাউকে আনন্দে চিৎকার করে ওঠার সুযোগ না দিয়ে তক্ষুনি টুপ করে ডুবেও গেল। কিছুক্ষণ ঢেউয়ের দুলুনি, আবার সুনসান।

অথচ ‘এমভি ছুটি’ জাহাজে করে যাঁরা এই পানখালির পশুর নদে এসেছেন, তাঁরা অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছেন ডলফিন দেখার জন্যই। খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালি দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে পশুর নদ। ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে নদীতীর থেকে সামান্য দূরে নোঙর ফেলেছে জাহাজটি। এখানে নাকি বিলুপ্তপ্রায় ডলফিনের দেখা মেলে সহজেই। তাই কেউ কেউ ক্যামেরার চোখে চোখ রেখেছেন, কেউ আবার বাইনোকুলারে চোখ রেখে তাকিয়ে আছেন। সবাই নিষ্পলক, উন্মুখ, অপেক্ষমাণ। একটু পর আবার দেখা গেল ডলফিনটি। এবার একসঙ্গে চোখে পড়ে অনেকের। কারও কারও ক্যামেরায় ধরা পড়ে। ক্ষণিক পরেই আবার একাধিক ডলফিন একসঙ্গে ভেসে ওঠে। ততক্ষণে বুঝতে পারি, আমরা সত্যিই ডলফিনপাড়ায় এসে পড়েছি!

গত ৪ নভেম্বর শুরু হওয়া ১০ দিনের ‘শুশুক মেলা’ উদ্​যাপনের অংশ হিসেবেই আমরা তখন জাহাজের যাত্রী। সকালে খুলনার রূপসা নদী থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল, পানখালিতে আসতে আসতে সন্ধ্যা। ডলফিনের মেলায় ডলফিন দেখব না তা তো হয় না; তাই জাহাজসুদ্ধ মানুষ নির্মল হাওয়া গায়ে মেখে তখনো ডলফিন দর্শনে মনোযোগী।

স্তন্যপায়ী এই প্রাণী বেশ সামাজিক ও খেলাপ্রিয়। জাহাজ বা নৌকার উপস্থিতি টের পেলে দারুণ আনন্দে খেলা করতে থাকে। ওদের আনন্দ-উচ্ছল ‘ভুশ-টুপ’ খেলা দেখে আনন্দ হয় আমাদেরও। এক, দুই, তিন...আমরা হিসাব করতে থাকি।

ডলফিন নৌকায় সচেতনতার বার্তা

নদীতীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল বিরাটকায় এক ডলফিন। ঠিক দাঁড়িয়ে নয়, নদীর মৃদু স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুলছে মৃদুমন্দ। ডলফিনের শরীর গোলপাতায় মোড়ানো, তার বুক চিরে বানানো হয়েছে প্রবেশপথ। প্রবেশপথ খুলতেই করতেই হইহই-রইরই করে বুকচেরা ডলফিনের পেটের ভেতর ঢুকে পড়ে পাড়ে উন্মুখ হয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা।

গোলপাতা মুড়িয়ে বিরাটকায় ডলফিনের আদলে তৈরি এটি মূলত একটি নৌকা। ‘শুশুক মেলা’ উদ্​যাপনের অংশ হিসেবে বানানো হয়েছে গোলপাতার এই ডলফিন নৌকা। ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো, এ যেন আস্ত এক গ্যালারি। গাঙ্গেয় ডলফিন এবং ইরাবতী ডলফিনের অপূর্ব সব স্থিরচিত্র ঝুলছে তাতে। পাটাতনে শৈল্পিকভাবে ফেলে রাখা হয়েছে ডলফিনের ভাস্কর্য। গলুইয়ের দিকে বানানো হয়েছে মঞ্চ।

এমন আয়োজনই ছিল ডলফিন নৌকার পেটের ভেতরে
এমন আয়োজনই ছিল ডলফিন নৌকার পেটের ভেতরে

সুন্দরবনের ঐতিহ্য গোলপাতা মুড়িয়ে নির্মিত বুকচেরা ডলফিনের নৌকা কি বিলুপ্তপ্রায় ডলফিনের কান্নার প্রতীকী উপস্থাপন? কথাটার সঙ্গে পুরোপুরি দ্বিমত পোষণ করলেন ডলফিন নৌকার নকশাকার কামরুজ্জামান স্বাধীন। তিনি বলেন, ‘বুকচেরা কান্না নয়; বরং বুকে আগলে রাখার ভাবনা থেকে এমন নকশা করা হয়েছে। ডলফিনের স্বাভাবিক জীবনযাপন পানির নিচে তার আশপাশের পুরো অঞ্চলের স্বাভাবিক পরিবেশের নিশ্চয়তা দেয়। এটা আসলে চারপাশকে বুকে আগলে রাখার মতোই ব্যাপার।’

শুরু থেকে চার দিন ছিলাম আয়োজনের অংশ হয়ে। কৃষ্ণপক্ষের রাত, সোনালি সকাল, দুপুরের রোদ, বাতাসের গতি, নদীর জোয়ার-ভাটা; সবকিছুর সঙ্গে সমন্বয় করে ‘এমভি ছুটি’ এগিয়ে চলেছে। ডলফিন নৌকাও এমভি ছুটির সঙ্গে ছুটে চলেছে সুন্দরবনসংলগ্ন জনপদগুলোতে। জয়মনি, চাঁদপাই, লাউডোব বাদামতলা, ঘাঘড়ামারী, ঢাংমারী, শরণখোলার মতো যেসব অঞ্চলের মানুষজনের জীবিকা সরাসরি নদীর সঙ্গে জড়িত, সেসব অঞ্চলে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে সচেতনতার বার্তা।

মেলাটি যৌথভাবে আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার, বাংলাদেশ (আইইউসিএন) এবং সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ (সিএনআরএস)। আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ)।

সচেতনতা তৈরিতে কাগজের ডলফিন
সচেতনতা তৈরিতে কাগজের ডলফিন

হালিম সরদারের বায়োস্কোপ

ডলফিন নৌকা উপস্থিত হওয়ার দিনক্ষণ জানিয়ে আগেই মাইকিং করে দেওয়া হয়েছে গ্রামে গ্রামে। ফলে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সবাই এসে জড়ো হচ্ছে নৌকার কাছে। নৌকা থেকে ডাঙায় মই ফেলে করা হয়েছে মানুষের যাতায়াতের সংযোগ। ডাঙায় রাস্তার পাশে, গাছের ডালে কিংবা নিকটবর্তী স্কুলের দেয়ালে ঝুলিয়ে স্থিরচিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। উন্মুক্ত জায়গায় বায়োস্কোপ খুলে নিয়ে বসেছেন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আসা আবদুল হালিম সরদার। বায়োস্কোপের ভেতর বিভিন্ন প্রজাতির ডলফিন, সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বানর কিংবা হরিণের ছবি। হালিম সরদার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একেকটি ছবি দেখান আর সুরে সুরে সেই সব প্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে যান। বিলুপ্তপ্রায় শুশুকের মতো বিলুপ্তপ্রায় আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ‘বায়োস্কোপ’ দেখতে উপচে পড়া শিশু–কিশোরদের ভিড়।

আয়োজনটা শিশুদের জন্য

ডলফিন নৌকার আগা গলুইয়ের দিকে যে মঞ্চ, তার সামনেরটা বড় দুটো হার্ডবোর্ড দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। বোর্ডের গায়েও ডলফিনের ছবি। পেছনে, মঞ্চে পুতুলনাচের আয়োজন। নৌকার পাটাতনজুড়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। রয়েছেন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষেরাও। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে সবাই। আয়োজকদের সঙ্গে আসা পুতুলনাচের দল জলপুতুল পাপেটসের সাইফুল ইসলাম জার্নালের মজাদার কথার ছোট্ট ভূমিকায় হেসে লুটোপুটি শিশুর দল। দেরি সইতে না পেরে তারাই ডাকতে শুরু করে মঞ্চের ওপারে থাকা পুতুলদের।

‘পুতুল আসো’ পুতুল আসো...।’

‘আমার ভীষণ লজ্জা করছে...।’

বলতে বলতে গানের পাখি পুতুল তার লজ্জাবনত মুখ তুলে ধরে। মুখর হাততালিতে দুলে ওঠে নৌকা। গানের পাখি গাইতে শুরু করে, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সঙ্গে এসে যুক্ত হয় র​্যাপসংগীতের শিল্পীরূপে পুতুল। একটু পরেই আসে সিংহের বাচ্চা ঘেউ। আসে শুশুক মানে ডলফিনরূপী পুতুল। শুধু শিশুরাই নয়, বড়রাও অপার বিস্ময় আর আনন্দ নিয়ে তা উপভোগ করতে থাকেন। এক অভাবনীয় দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তীরসংলগ্ন স্বল্প পানিতে ভাসমান নৌকার ওপর।

এরা সবাই জানতে চায়, ডলফিন তো কোনো ক্ষতি করে না মানুষের, অথচ মানুষ তাদের সঙ্গে অবন্ধুসুলভ আচরণ করে কেন? তারা ডলফিনের কাছে পানিতে ময়লা না ফেলা কিংবা জালে আটক না করার প্রতিজ্ঞা করে। তাদের সঙ্গে গলা মেলায় উপস্থিত আবালবৃদ্ধবনিতা, সবাই।

পুতুলনাচ শেষে আয়োজন করা হয় কর্মশালার। আমন্ত্রিত স্কুলশিক্ষার্থীরা গোল হয়ে বসে নৌকার ভেতর। হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়া হয় রঙিন কাগজ, কলম, কাঁচি। জলপুতুল পাপেটের সদস্যরা নির্দেশনা দেন পাটাতনের এপাশ–ওপাশ হেঁটে হেঁটে। কাগজ কেটে, কলমে এঁকে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই বানিয়ে ফেলে কাগজের শুশুক। শুধু বানিয়েই ক্ষান্ত হয় না, নিজ হাতে বানানো রঙিন শুশুকের গায়ে কেউ লেখে নিজের নাম, কেউবা লেখে ছড়া-কবিতা। কেউ কেউ কালো কলম দিয়েই আঁকে সবুজ ধানখেত, ছায়াঢাকা গ্রাম, পাশ দিয়ে বয়ে চলা পশুর নদ, নদে চলমান পালতোলা নৌকা, নৌকার পাশে ‘ভুশ’ করে ওঠা শুশুক।

মূলত এটা শিশু–কিশোরদের অবচেতন মনে ডলফিনের প্রতি মমত্ববোধ তৈরির চেষ্টা। এই প্রজন্মের ভেতর যদি ডলফিনের প্রতি ভালোবাসা জন্মায় তাহলে ডলফিনের অস্তিত্ব রক্ষার দায়িত্ব তারাই নিয়ে নেবে—এমন ভাবনা থেকেই এই আয়োজন।

হঠাৎ দেখা মিলল ডলফিনের
হঠাৎ দেখা মিলল ডলফিনের

ডলফিনের দুনিয়া

বিশ্বে প্রায় ৪৩ প্রজাতির ডলফিন রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ৭ প্রজাতির ডলফিনের দেখা মেলে বলে প্রকাশনায় তুলে ধরেছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)। গাঙ্গেয় ডলফিন বা শুশুক বাংলাদেশের মিঠাপানির নদীর প্রধানতম ডলফিন প্রজাতি। সুন্দরবনের নদীতে গাঙ্গেয় শুশুক এবং ইরাবতী ডলফিন দেখা যায়। এই দুই প্রজাতির ডলফিনই বর্তমানে সারা বিশ্বে বিপন্ন অবস্থায় আছে।

সম্প্রতি বন বিভাগ ও ইউএনডিপির প্রকাশিত জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ছয় হাজার ইরাবতী ডলফিন আছে। এগুলোসহ সারা বিশ্বে এই ডলফিন আছে মাত্র ৭ হাজার। সাধারণত গাঙ্গেয় শুশুক বেশি দেখা যায় দুটি নদীর মিলনস্থল, নদীর বাঁক ও গভীর অংশে। এরা দেখতে ধূসর-বাদামি রঙের। এদের প্রধান খাদ্য মাছ। অন্যদিকে ইরাবতী ডলফিন বেশি দেখা যায় নোনা পানি ও নদীর মোহনায়। দেখতে সাধারণত ধূসর বা নীলচে ধূসর ও পেটের দিকে ফিকে বর্ণের হয়। মাছ, সামুদ্রিক স্কুইড, অক্টোপাস ও চিংড়ি ইরাবতী ডলফিনের প্রধান খাদ্য।

উপকারী ও নিরীহ প্রাণী ডলফিন বা শুশুক। জলজ পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে এদের ‘উপকূলীয় প্রতিবেশের প্রহরী’ বলা হয়।