স্মৃতিগুলি আছে পরম যত্নে

মালেকা খান। ছবি: খালেদ সরকার
মালেকা খান। ছবি: খালেদ সরকার
বর্বর পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশুদের পুনর্বাসনের জন্যই গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা। কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল সেই সংগঠন। কাজ করে গেছে ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশুদের পুনর্বাসনে। সেই সংস্থার পরিচালক ছিলেন সমাজকর্মী মালেকা খান। সংস্থার সেই সময়ের কার্যক্রম নিয়ে বলেছেন তিনি।

আমার চোখে ভাসে পাঁচটি মায়াভরা মুখ। এখনো ওদের বয়স যেন পাঁচ বা ছয়ে স্থির হয়ে আছে। কারণ ১৯৭২ সালে ওই বয়সেই ওদের প্রথম দেখেছিলাম। রমেন, রতন, শাহ আলম, ফারুক আর কাসেম। ওরা আসত ২০ নম্বর নিউ ইস্কাটনের বাড়ি থেকে দেয়াল টপকে। আমাদের বাড়িটি ছিল ১৯ নম্বর। বাড়ির সামনে বড় মাঠ আর তাতে ফুটবল খেলতাম আমরা।

কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থায় একজন নির্যাতিত নারীর বিবাহ অনুষ্ঠানে কন্যা সম্প্রদান করেছেন সংস্থাটির সভাপতি কবি সুফিয়া কামাল। ছবি: সংগৃহীত
কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থায় একজন নির্যাতিত নারীর বিবাহ অনুষ্ঠানে কন্যা সম্প্রদান করেছেন সংস্থাটির সভাপতি কবি সুফিয়া কামাল। ছবি: সংগৃহীত

সমাজকর্মী মালেকা খানের কাছে এসেছি, কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থার কথা শুনব বলে। তিনি প্রথমে ওই সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন, এরপর ১৯৭৩ সালে পরিচালক হয়ে কাজ করেছেন ১৯৭৬–এর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। তাঁর কাছে এই শিশুদের নামগুলো অজানা নয়। ওই বাড়িটাতেই ঠাঁই হয়েছিল ওদের। মালেকা খান রমেন আর রতন সম্পর্কে বললেন, ‘ওদের বাবাকে প্রথমে হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা। এরপর ওদের মাকেও। ওরা দুই ভাই। এতিম এই বাচ্চা দুটোকে আমরা নিয়ে এসেছিলাম পুনর্বাসন সংস্থায়।’
যুদ্ধে আমি হারিয়েছিলাম বাবা, রমেন–রতনের বাবা–মা কেউ ছিল না। মোচড় দিয়ে উঠল বুকটা।
তখন আমরা ছোট, তাই বুঝতাম না পাশের বাড়িতে কারা থাকেন। তবে ২০ নিউ ইস্কাটনের দোতলা থেকে কখনো কোনো উদাস চোখের নারীকে দেখেছি জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে। লক্ষ করেছি, তাঁরা কখনোই হাসতেন না। মালেকা খানের স্মৃতির ভান্ডারে এ রকম অনেক স্মৃতি এখনো সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।

কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানাচ্ছেন কবি সুফিয়া কামাল। ১৯৭২। ছবি: সংগৃহীত
কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানাচ্ছেন কবি সুফিয়া কামাল। ১৯৭২। ছবি: সংগৃহীত

ভয়াবহ দিনগুলি
ঢাকার শাহীনবাগের নিজ বাড়িতে এই প্রবীণার পাশে বসে যখন স্মৃতিচারণ শুনছি, তখন মনে হচ্ছিল, তিনি যেন এখনো স্মৃতিগুলোকে রেখে দিয়েছেন পরম যত্নে। স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের একটা বিভীষিকাকে কীভাবে তাঁরা মোকাবিলা করেছিলেন, তা করুণ গল্পের মতো, কিন্তু প্রতিটি শব্দই সত্য, প্রতিটি শব্দই ইতিহাস।
বিজয়ের আনন্দে যখন সারা দেশ মুখর, সে রকম সময়েই আস্তে আস্তে বোঝা যেতে থাকল সংকটগুলো। পাকিস্তানিরা আর তাদের এ দেশের দোসরদের হাতে নির্যাতিত বাংলাদেশের নারীদের অবর্ণনীয় জীবনযাপনের খবর আসতে লাগল সারা দেশ থেকে।
বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা গড়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের পরপরই। ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে তখনকার সাংসদ বেগম বদরুন্নেসা আহমেদের সহযোগিতায় গড়ে ওঠে এই সংস্থা। সরকারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় এ কাজে সহযোগিতা করবে, এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালক বজলুল মজিদ তাঁর কর্মী বাহিনীকেও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের কাজে নিয়োজিত করেন। সুফিয়া কামালকে সভাপতি করে সংস্থার ১২ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়।
সংস্থা কী কাজ করবে, সেটাই ছিল মূল ভাবনার জায়গা। বর্বর পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশুদের উদ্ধার করা, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের হাত থেকে হতভাগ্য নারীদের রক্ষা করা, নির্যাতিত নারীদের যুদ্ধশিশুদের দেশে ও বিদেশে দত্তক দেওয়া।

কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থায় আশ্রিত শিশুদের সঙ্গে কবি সুফিয়া কামালসহ সংস্থার পরিচালক ও কর্মকর্তারা
কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থায় আশ্রিত শিশুদের সঙ্গে কবি সুফিয়া কামালসহ সংস্থার পরিচালক ও কর্মকর্তারা

মাদার তেরেসা
কবি সুফিয়া কামাল মালেকা খানকে পাঠালেন মাদার তেরেসার সঙ্গে দেখা করতে। মাদার তেরেসা তখন ছিলেন ঢাকার ইসলামপুরে। সেটা ১৯৭২ সালের কথা। মাদার বলেছিলেন, ‘যুদ্ধশিশুদের কী অপরাধ? তোমরা অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের হাত থেকে মেয়েদের বাঁচাও, তাঁদের সেবা করো, তাঁদের ভালোবাসা দাও। যারা পৃথিবীর আলো দেখেছে তাদের বাঁচতে দাও।’ আরও অনেক কথাই বলেছিলেন
মাদার তেরেসা। আজও তা ভোলেননি মালেকা খান।
এ কথা জেনে কবি সুফিয়া কামাল ছুটলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। আইনে নেই বলে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ–পরবর্তী পরিস্থিতির কথা মনে রেখে স্বল্পকালের জন্য অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে গর্ভপাত আইন ও আন্তর্জাতিক শিশু দত্তক আইন প্রবর্তন করেন।

কাজ আর কাজ
সারা দেশে নির্যাতিত নারী ছিলেন কয়েক লাখ। ১৯৭৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত পাঁচ হাজারেরও বেশি নারীকে অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের হাত থেকে মুক্ত করা হয়েছিল এই সংস্থায়। সহস্রাধিক নারীকে নিজ নিজ পরিবারে ফিরে যেতে সর্বতোভাবে সাহায্য করা হয়েছিল। ৪০টি শিশুকে দেশের ভেতরে ও বাইরে দত্তক দেওয়া হয়েছিল। ৫০০ জনের বেশি নারীকে বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আশ্রিত শিশুদের জন্য ২০ নিউ ইস্কাটনে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিলেন।

যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের অনুদান দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। তারই একটি চিঠি
যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের অনুদান দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। তারই একটি চিঠি

কয়েকটি ঘটনা
আশ্রয় পাওয়া বেশির ভাগ মেয়েই ছিলেন নির্বাক। তাঁদের মুখে হাসি ছিল না। কেউ কেউ একেবারেই কথা বলতেন না। মালেকা খান বললেন, ‘আমরা সবাই মিলে খুবই কোমলভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতাম। কোনো কোনো মেয়ে সারা রাত কাঁদত। একটি মেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল, এক ভদ্রলোক তাকে বিয়ে করে স্নেহ–ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন। চাকরির জন্য যখন সাক্ষাৎকারের প্রশ্ন আসত, তখন মেয়েটিকে নিয়ে নিজেই গিয়েছি, নিজেই বসেছি ইন্টারভিউ দিতে। বলেছি, ও এই কাজ পারবে। এখন কথা বলার অবস্থায় নেই। শুধু ঘরের বাইরে ওকে চেয়ারে বসিয়ে রাখবেন না। ঘরের মধ্যেই একটা চেয়ার পেতে দেবেন। এভাবে কারও কারও চাকরি হয়েছিল।’
কবি গোলাম মোস্তফার মেয়ে ফিরোজা খাতুন ভালো গান গাইতেন। বড় ঘরে নির্বাক, বিষণ্ন মেয়েদের কাছে গিয়ে গান করতেন তিনি। কিন্তু নির্বাক মেয়েদের তাতে প্রাণচাঞ্চল্য আসত না। রবীন্দ্রসংগীতের পর একটা লোকগীতি গাইতেই একটি মেয়ের চোখে একটু হাসির আভাস দেখা গেল। লোকগীতিটা চলতেই থাকল, কয়েকজন মেয়ে তাতে সাড়া দিেলন। তাঁদের মুখে হাসি ফুটল। এটা দারুণ কাজ দিয়েছিল বলে মনে করেন মালেকা খান।
একটি আশ্রিতা মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করে কবি সুফিয়া কামাল আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে স্বামীর হাতে সম্প্রদান করেছিলেন। বেগম মুজিব মেয়েটিকে উপহার দিয়েছিলেন একটি সোনার হার। ছবিটি দৈনিক বাংলা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

২০ আর ৮৮
২০ নিউ ইস্কাটনটিকে গড়ে তোলা হয় প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের জন্য ৮৮ নম্বর বাড়িটা ছিল আশ্রিতদের আবাসিক কেন্দ্র হিসেবে। প্রশিক্ষণের জন্য সেলাই বিভাগ, মসলা গুঁড়া বিভাগ, হাঁস–মুরগি পালন বিভাগ, চামড়ার তৈরি দ্রব্যের বিভাগ, ডে কেয়ার সেন্টার, বয়স্ক শিক্ষা বিভাগ, রান্না বিভাগ গড়ে তোলা হয়েছিল। মালেকা খান বললেন, ‘ওরা মুখে কথা বলত না। কিন্তু অনেকেই ছিল গ্রামের মেয়ে। হাতের কাজ খুব ভালো জানত। ওরা ছোট ছোট কাঁথা সেলাই করত, শিকা তৈরি করত, তাতে যেন থেরাপির মতো কাজ হতো। এভাবেই নির্বাক মুখেও কথা ফুটত। ২০ নম্বর নিউ ইস্কাটনের সামনেই ছিল সংস্থার ‘কমলকলি’ নামে একটি দোকান। সেখানে বিক্রি হতো মেয়েদের হাতের তৈরি জিনিসপত্র।

একটি স্বপ্নের মৃত্যু
সোনারগাঁয়ের পানাম নগরে একটি দোতলা বাড়িতে কবি সুফিয়া কামাল সমবায় শিল্পগ্রামের উদ্বোধন করেছিলেন। জমি অধিগ্রহণে সহযোগিতা করেছেন। এটি ছিল নির্যাতিত মেয়েদের পুনর্বাসিত করার স্থায়ী পরিকল্পনা। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কার্য পরিচালনার জন্য নতুন কমিটি হয়। তাদের অদূরদর্শিতা ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সংস্থার সমবায় শিল্পগ্রাম বা সোনারগাঁ ক্রাফট ভিলেজ প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। নতুন কমিটি হওয়ার সময় মালেকা খান নিজ পদ থেকে ইস্তফা দেন।

একটি কমলা সোয়েটার
যখন মালেকা খান কাজ থেকে ইস্তফা দেন, তখন চারজন নারী ছিলেন সেখানে। দুজন যুদ্ধাহত, একজন বৃদ্ধা ও একজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী।
মালেকা খান কথা থামালে আমি তাঁকে বলি, ‘আপনারা ওই সময় যে মেয়েদের জন্য সহজ–স্বাভাবিক জীবন গড়ে দিচ্ছিলেন, তাঁদের একটা স্মৃতি আমার কাছে আছে।’
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন মালেকা খান।
বললাম, ‘বাজার থেকে উল কিনে আমাদের ছোট তিন ভাইয়ের জন্য সোয়েটার বানাতে দেওয়া হয়েছিল কমলকলিতে। আমার ছোটবেলায় কমলা রঙের সোয়েটারটি যিনি বুনে দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন আপনাদেরই পুনর্বাসন সংস্থার একজন নারী। সোয়েটার বানানোর সময় আমরা উঁকি দিয়ে দেখতাম, কাজ কতটা এগোল। সেই স্মৃতিচিহ্নটি এখনো আমার কাছে আছে।’
মালেকা খানের চোখের কোণে কি কিছু দেখলাম, নাকি তা আমারই চোখের ভুল?