আসবাব

>

আদিকাল থেকেই সংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গে আসবাবের ক্রমবিবর্তন ঘটছে। তবে আসবাব ব্যবহারের যে আদিকাল, সেটা কত আগের? সময়রেখায় রইল সে খোঁজ


খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১৫
স্কটল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলীয় ওর্কনে অঞ্চলের স্কারা ব্রেতে এখনো রয়েছে নব্য প্রস্তর যুগের বসতির নিদর্শন। এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পর্যবেক্ষণ করে গবেষকেরা জানিয়েছেন, নব্য প্রস্তর যুগের মানুষই ঘরে ব্যবহারের জন্য বিছানা, চেয়ার ও আলমারি তৈরি করতেন। এ যুগের মানুষেরা প্রথম পাথর ব্যবহার করে আবাসস্থল-অস্ত্রসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করতে শিখেছিলেন। তাই ধারণা করা হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরির সে ধারাবাহিকতায় খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগে আসবাবও তৈরি করা হতো।


খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২০০০
মিসরের অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও রাজা ছিলেন তুতেনখামেন (খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৪১-১৩২৩)। তাঁর সমাধিস্থল থেকে বিভিন্ন ধরনের আসবাবের নমুনা পাওয়া যায়। সেসব আসবাব থেকে ধারণা করা হয়, সে যুগে মিসরের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বাড়িতে বিভিন্ন নকশার টেবিল, চেয়ার, বিছানা, আলমারি ও চৌকি ব্যবহার করা হতো।

মিসরীয় সেসব আসবাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল লম্বা লম্বা সারি ও চার কোনা বক্স আকৃতির নকশা। কাঠ খোদাই করে, হাতির দাঁত কিংবা স্বর্ণ দিয়ে তৈরি আসবাবগুলো ঘরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিত বহুগুণ।


খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০-৩০০
প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন তাদের আসবাব। আধুনিক মঞ্চের উদ্ভবও গ্রিক সভ্যতায়। গ্রিক দার্শনিকেরা টেবিলে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতেন, তাঁদের সে অভ্যাস থেকেই কালক্রমে আজকের মঞ্চ।

ভৌগোলিক কারণে গ্রিসের আসবাবের মধ্যে মিসরীয় সভ্যতার ছাপ রয়েছে। মিসরীয় সভ্যতার চার কোনা বক্স আকৃতির নকশার সাদৃশ্যও পাওয়া যায়। তবে গ্রিকেরা সময়ের সঙ্গে তাদের আসবাবে নতুনত্ব নিয়ে আসে। বর্তমানে আমরা যে সোফা ব্যবহার করি, এটা গ্রিক সভ্যতার অবদান।

৫০০-১৪৫০ সাল
টেরাকোটা শিল্প, দেবদেবীর প্রতিকৃতি, মন্দিরভিত্তিক চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, কাঠ ও হাতির দাঁতের কাজের নমুনা থেকে বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের আসবাব সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। ইউরোপে মধ্যযুগের বাড়িগুলো সাধারণত ছিল এক কক্ষের। তবে সে কক্ষগুলো ছিল বেশ বড়সড়। তাই সে সময়ের আসবাবও আকৃতিতে বেশ বড় হতো। আসবাবে বার্নিশ বা রঙের ব্যবহার শুরু হয় মধ্যযুগ থেকেই।

১৩৫০-১৫৫০ সাল
চৌদ্দ শতকে শুরু হয়ে পনেরো শতক নাগাদ ইউরোপের দেশে দেশে সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিতে রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ ঘটে। ইতালীয় রেনেসাঁ শিল্পীদের অনুপ্রেরণার উৎস ছিল মূলত গ্রিক শিল্পীরা। তাই সে যুগের ইতালীয় আসবাবগুলোতে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার সাদৃশ্য পাওয়া যায়, সঙ্গে যোগ হয় আধুনিক শিল্পকলা। এ সময়ের টেবিলগুলো ছিল চতুর্ভুজাকৃতির, কিন্তু পায়াগুলো ছিল বাঁকানো নকশা করা। চেয়ারগুলো ছিল তুলনামূলকভাবে উঁচু, ঠেস দেওয়ার জন্য যোগ হয় কুশন।

রেনেসাঁ যুগের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নকশায় পৌরাণিক বিভিন্ন চরিত্রের অন্তর্ভুক্তি। গ্রিক কিংবা রোমান বিভিন্ন দেব-দেবীর মুখাবয়ব এবং চিত্র ফুটিয়ে তোলা হতো আসবাবগুলোর নকশাতেও।

১৫০০-১৮০০ সাল
এই সময়টাকে ধরা হয় কলোনি যুগ। কারণ, ইউরোপের কিছু দেশ বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রাজ্যগুলো দখল করে একেকটা কলোনি গড়ে তোলে। এতে ইউরোপের বিভিন্ন উদ্ভাবন কলোনিগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই যুগের আসবাবগুলো ছিল তুলনামূলকভাবে হালকা, পায়াগুলো হয়ে আসে আগের চেয়ে সরু।

আঠারো শতকের শেষ অবধি বাংলার আসবাবের নকশা ও কারুকার্যের উৎস ছিল প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতি এবং মধ্যযুগের মুসলিম সংস্কৃতি। এ ছাড়া কাঠ ও হাতির দাঁতের ওপর কাজ করার প্রাচীন প্রাচ্যের কৌশলও উৎস হিসেবে কাজ করেছে।


১৮০০-১৯০০ সাল
উপমহাদেশেও আধুনিক আসবাবের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনের একটা সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ইউরোপের বণিকেরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত তাঁদের ব্যবসায় কেন্দ্রগুলোতে সমসাময়িক ইউরোপিয়ান নকশার আসবাব দ্বারা অফিস ও বাসগৃহ সজ্জিত করতেন। সেসব নকশা ধীরে ধীরে স্থানীয় মানুষ ব্যবহার করতে শুরু করে।

আসবাবের বিবর্তনের এই সময়কে বলা হয় জাগরণের যুগ। প্রথম শিল্পবিপ্লবের কারণে পৃথিবী হয়ে ওঠে উৎপাদননির্ভর। তাই এই সময়ে নকশার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করে সহজে ও কম খরচে বেশি আসবাব তৈরি।

বিংশ শতক-বর্তমান
এই সময়ে আসবাব নির্মাণকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে আসেন কারিগরেরা। কম কাঠ দিয়ে তৈরি আসবাবে কীভাবে নকশা ফুটিয়ে তোলা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন নির্মাতারা।

উনিশ শতকের শেষ নাগাদ ফ্রান্সে উদ্ভব হওয়া আর্ট নুভো বা নব্য শিল্প নামে একধরনের শৈল্পিক চর্চা, যার ছাপ পড়ে আসবাবের নকশাতেও। আসবাবের নকশায় যোগ হয় জ্যামিতিক বিভিন্ন আকৃতির সদৃশ নকশা। আসবাবশিল্পে এ সময় আরও যোগ হয় জার্মান বাউহাউস ও ফরাসি আর্ট ডেকো স্টাইল। ভালো নকশা মানেই ভারী আসবাব—এই চিরাচরিত ধারণা থেকে বের হয়ে আসে আসবাবশিল্প।

সময়ের বিবর্তনে কাঠের আসবাবের সঙ্গে স্টিল, অন্যান্য ধাতু ও প্লাস্টিকের তৈরি নানা ধরনের আধুনিক আসবাব বিস্তার লাভ করে। এগুলো এখন বাসগৃহ, অফিস, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল ও সম্মেলনকেন্দ্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্টাডি ডট কম ও বাংলাপিডিয়া অবলম্বনে আকিব মো. সাতিল