ঢাকায় নতুন জাদুঘর

>ঢাকার ঐতিহাসিক নিমতলী প্রাসাদের নাম এখনো লোকমুখে রয়ে গেছে। বাস্তবে প্রাসাদটি নেই। টিকে আছে কেবল প্রধান প্রবেশদ্বার। সেখানে এখন গড়ে তোলা হয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর। সম্প্রতি দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির দ্বার।
জাদুঘরের একটি গ্যালারিতে রাখা বিভিন্ন স্মারক ও ছবি
জাদুঘরের একটি গ্যালারিতে রাখা বিভিন্ন স্মারক ও ছবি

ঢাকার নায়েব নাজিমদের (ডেপুটি গভর্নর) শেষ চিহ্ন নিমতলী দেউড়ি। দেউড়ি বা গেট আসলে নিমতলী প্রাসাদের পশ্চিম দিকের তোরণ। বাস্তবে বা ছবিতে অনেকেই দেখেছেন। অনেকে একে নিমতলী প্রাসাদও বলে থাকেন। তবে প্রাসাদটির কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই। কেবল ভবনের প্রধান প্রবেশদ্বারটি টিকে আছে। এটি ‘নিমতলীর দেউড়ি’ বলেই পরিচিত।

এত দিন ঐতিহ্যের কঙ্কাল হয়ে টিকে ছিল। নতুন রং লেগেছে। দেখলে মনে হবে মাঝারি আকৃতির কোনো সুরম্য ভবন।

আমরাও পুরোনো স্থাপনার চমৎকার নতুন উপস্থাপনের বিস্ময় নিয়েই ঢুকে যাই ভেতরে। সাধারণ ইটের ভবনের তিনতলা সমান উঁচু এই দেউড়ি ভবন। দেউড়ি অর্থাৎ প্রবেশপথটি ঠিক মধ্যে। এটাই দুই তলা সমান। এখানেই এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘরটি। দর্শকের জন্য এর দ্বার খুলে দেওয়া হলো ৩ জানুয়ারি। আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে সাধারণ দর্শকদের জন্য প্রতি শুক্র ও শনিবার খোলা থাকছে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। শুক্রবার বেলা ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত নামাজের বিরতি।

ভবনের নিচতলায় ডান দিকে পাশাপাশি দুটি ঘর। প্রতিটি ঘরে তিন দিকের দেয়ালে স্মারক রাখার জায়গা করা হয়েছে। আর বাঁয়ে আছে একটি ঘর। দেউড়ি ভবনেই ছিল এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম কার্যালয়। নিচতলায় তাই রাখা হয়েছে ১৯৫২ সালের ৩ জানুয়ারি যাত্রা করা এশিয়াটিক সোসাইটির নানা স্মারক। আরেকটি ঘরে ডিজিটাল মনিটরে নায়েব নাজিমদের আমলে ঢাকার ইতিহাসভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে।

নিচতলায় তিনটি গ্যালারি দেখে সরু একটি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। পুরোনো সিঁড়িতে কাঠ বসিয়ে নতুনত্ব দেওয়া হয়েছে। দোতলায় একটি ঘর, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে প্রায় সমান। আলোকচিত্র ও তৈলচিত্র আছে বেশ কিছু। পরের বিস্ময় তৃতীয় তলায়। এখানেই জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গ্যালারি। ৪৫ ফুট দৈর্ঘ্যের এই কামরায় রাখা হয়েছে মসলিন, ধাতব মুদ্রা ও তৈজসপত্র। সুপরিসর ঘরে নবাব নুসরাত জংয়ের দরবারের ত্রিমাত্রিক উপস্থাপনাও তুলে ধরা হয়েছে। যেন জীবন্ত! হঠাৎ করে দেখে মনে হবে দরবারে বসে আছেন নুসরাত জং। নবাবের হাতে হুঁকার নল। পেছনে একজন কাপড়ের পাখায় নাড়িয়ে বাতাস দিচ্ছে নবাবকে।

পুরো ভবনটা এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন দর্শনার্থীরা নবাবি আমলে ফিরে যেতে পারেন। ১৭ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের স্মারক দেখা গেল জাদুঘরে। সময়কাল ধরে ধরে সাজানো হয়েছে।

ঐতিহ্য জাদুঘরের মূল ভবন
ঐতিহ্য জাদুঘরের মূল ভবন

ঢাকায় সুবেদারি আমলের পর আসে নবাবি আমল। নায়েব নাজিমদের নবাব নামেই ডাকা হতো। ঢাকা নিয়াবত বলা হতো এই অঞ্চলকে। তখনকার ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে। নবাবদের তালিকা আছে। তাঁদের কাজকর্মের বর্ণনা আছে। নবাবদের আওতায় ত্রিপুরা আর চট্টগ্রামও ছিল। তার বর্ণনাও দেখা গেল জাদুঘরে। আছে তখনকার দালানকোঠা, মসজিদ, ভবন সম্পর্কেও তথ্য। ঢাকার গান-বাজনা, পোশাক, খাবার নিয়েও থাকছে অনেক তথ্য। সব মিলে পাঁচটি কক্ষে পাঁচ গ্যালারি।

এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘরের প্রধান সমন্বয়ক শরীফ উদ্দিন আহমেদ বললেন, ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও একাডেমিক প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে জাদুঘরটি চালু করা হয়েছে। একে একটি শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। মোগল ও ব্রিটিশ শাসনামলের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম-সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেবে জাদুঘর। সর্বোপরি সাধারণ ঐতিহ্যপ্রেমী নাগরিক, দর্শক, ঢাকাপ্রেমী, গবেষক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অতীত ঐতিহ্য তুলে ধরা এই জাদুঘরের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য।

 স্মারকের সন্ধানে

এশিয়াটিক সোসাইটির দুটি ভবনের মধ্যে প্রায় আড়ালেই ছিল জীর্ণ ভবনটি। শরিফ উদ্দিন আহমেদ বললেন, একসময় সংস্কারের কথা ভাবা হলো। অনুমোদনও পাওয়া গেল। সব সামলে নিয়ে নিমতলী দেউড়ি সংস্কারে হাত দিলেন। সঙ্গে ছিলেন স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ। দেশ-বিদেশে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। নেওয়া হলো পরামর্শ।

শেষ পর্যন্ত সফলভাবেই সংস্কার হলো ভবনের। কিন্তু জাদুঘর সাজবে কীভাবে? রেপ্লিকা? অন্য জাদুঘর থেকে ছবি তুলে আনা? এমনটা ভাবতে ভাবতে কয়েকটি কর্মশালার আয়োজন করা হলো। সেখানে সংগ্রাহক থেকে শুরু করে ঢাকা নিয়ে
কাজ করে, এমন ব্যক্তিরাও ছিলেন।
 আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ঢাকার আদি বাসিন্দাদেরও।

শরীফ উদ্দিন আহমেদ নিজে ঢাকার বনেদি বাড়িগুলোতেও গিয়েছেন। জাদুঘর সম্পর্কে বলেছেন, বুঝিয়েছেন। চালু হওয়ার পর এখন অনেকেই এখানে নিদর্শন দেওয়ার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন, যোগাযোগ করছেন।

জাদুঘরের কিউরেটর জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ১৭ জন ব্যক্তির কাছ থেকে ইতিমধ্যে ৮৩টি স্মারক পাওয়া গেছে। সবই প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে মসলিন শাড়ি, ধাতব মুদ্রা, আসবাব, তৈজসপত্র, দরবারে ব্যবহার হতো এমন হুঁকা, কাঁটা চামচ, চাকু, রাইস ডিশ, প্লেট, বাটি, স্যুপের পাত্র, শাড়ি, শাল, হরিণের শিং, ক্যাশবাক্স, বাতি, কলস, ঝাড়বাতি, পানদান, কোরআন শরিফ, গয়নার বাক্স, সাবানদানি, দোয়াত ইত্যাদি। এগুলো দিয়েছেন জেবউননেছা, মুহাম্মদ জালালউদ্দিন, আনজালুর রহমান, শায়লা পারভীন, সৈয়দ আবেদ হাসান, জিন্নাতুল বাকিয়া, এ ই আর খান, সাদউর রহমান, হাশমতি আরা বেগম, হোমায়রা খাতুন, মো. রফিকুল ইসলাম, নাজমুল হক, মালিয়া আলম, জিনাত পারভীন, সুলতান মাহমুদ রহমান, লুৎফুল করিম ও আবদুস সালাম। তাঁরা সবাই পুরান ঢাকার বাসিন্দা।

তবে একটা আফসোস রয়েই গেছে। এই ভবনের সঙ্গে জড়িত কোনো স্মারক এখনো পাওয়া যায়নি। কিউরেটর জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘ভবনটা উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। যাঁরা কিনেছিলেন, তাঁরা প্রায় সবকিছুই নিয়ে গেছেন। যে ব্যবসায়ী কিনেছিলেন, তাঁদের কেউই আর এখানে নেই। তবে এই ভবনের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু উপকরণ জাতীয় জাদুঘর ও আহসান মঞ্জিলে আছে। চেষ্টা করব, সেখান থেকে কিছু সংগ্রহ করার।’