আমাদের টাঁকশাল

>

টাঁকশালের প্রধান ফটক। ছবি:  দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া
টাঁকশালের প্রধান ফটক। ছবি: দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

টাঁকশাল নামেই পরিচিত। পোশাকি নাম দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড। দেশের টাকা ছাপানোর একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান গাজীপুরে। টাঁকশালের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। এ বছর এসে পূর্ণ হলো ৩০ বছর। টাঁকশাল নিয়েই এই প্রতিবেদন।

বিশ্বে স্বাধীন দেশের সংখ্যা প্রায় ২০০। তবে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে নোট মুদ্রণের ছাপাখানা আছে মাত্র ৬৫; যার মধ্যে বাংলাদেশের টাঁকশাল একটি। নাগরিক হিসেবে ব্যাপারটা নিশ্চয় মর্যাদা ও গর্বের। দেশের মানুষের কাছে ‘টাঁকশাল’ নামে বেশি পরিচিত বাংলাদেশের টাকা ছাপানোর প্রতিষ্ঠানটির পোশাকি নাম ‘দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড’।

টাঁকশালের অভ্যন্তরে

ইংরেজি শব্দ ‘মিন্ট’-এর বাংলা হচ্ছে টাঁকশাল—যেখানে কাঁড়ি কাঁড়ি ধাতব মুদ্রা বা কয়েন বানানো হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছাপালেও বাংলাদেশের টাঁকশালে কোনো কয়েন তৈরি হয় না। আর্থিকভাবে লাভ-লোকসান বিশ্লেষণে দেশের জন্য কয়েন উৎপাদন লাভজনক বিবেচিত না হওয়ায় আমাদের টাঁকশালে এখনো কয়েন তৈরির কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি এবং এ জন্য কয়েন তৈরির কোনো মেশিনও সংস্থাপন করা হয়নি। তবে টাঁকশালে শুধু যে টাকাই ছাপা হয়, ব্যাপারটা এমন নয়। টাকা ছাপানোর উদ্দেশ্যে স্থাপিত হলেও সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তাসামগ্রী এখানে ছাপানো হয়, যেমন: অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সঞ্চয়পত্র, নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, রাজস্ব স্ট্যাম্প, আদালতে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক সামগ্রী, স্মারক ডাকটিকিট, খাম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ট্যাক্স লেবেল, ব্যাংকের চেক বই, প্রাইজবন্ড, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর জিএসপি ফরম, দেশের সব শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার নম্বরপত্র ও সনদ ইত্যাদি। এ ছাড়াও কোনো কোনো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে তাদের শিক্ষা সনদও মুদ্রণ করা হয়ে থাকে।

টাকা মুদ্রণের কারণে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ প্রচুর। প্রায় ৬৬ একর জায়গা নিয়ে দেশের টাকা তৈরির একমাত্র এই কারখানা বৃক্ষশোভিত। আর গাছগাছালিতে ভরা বলেই টাঁকশালের অভ্যন্তর সব সময় পাখির কলরবে মুখরিত থাকে। শুধু প্রাকৃতিক দিক থেকেই নয়, টাকা মুদ্রণের একক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটি দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে কিছুটা ভিন্নও। কিন্তু বিদ্যমান বহু স্তরে নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মী ও প্রতিষ্ঠানটিকে কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয়। পুলিশের প্রায় ৮০ জন সদস্য প্রতিষ্ঠানের বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে।

এই ছাপাখানায় প্রবেশ করতে হলে চারটি ফটকে নিরাপত্তাকর্মী ও পুলিশকে প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবেশন করতে হয়। প্রেসের মূল ফটক ও ভেতরের ঘরগুলোতে কর্মচারী, কর্মকর্তাদের চলাচলে অ্যাকসেস কন্ট্রোল ছাড়াও সব কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং অনুমতি পাওয়া গ্রাহকদের ছাপাখানায় প্রবেশের সময় দেহতল্লাশি করা হয়। ব্যক্তি ও মালপত্রের আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও সংশ্লিষ্ট তথ্য লিখে রাখার জন্য করপোরেশনের নিজস্ব শতাধিক নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রেসের অভ্যন্তরে চলাচলেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়ে থাকে।

মুদ্রণসহ যেকোনো নিরাপত্তাসামগ্রী উৎপাদনে বেশ কিছু পর্যায়ে বিভিন্ন ঘরে (হল) কাজ করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত কর্মচারী ও কর্মকর্তা ছাড়া এক হল থেকে অন্য হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যেতে পারেন না। প্রতিটি হলের জন্য আলাদা এন্ট্রি পাস ছাড়াও দরজায় নিরাপত্তাকর্মীরা অন্যদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।

উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা রয়েছে। সংগৃহীত কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রীর মধ্যে সমন্বয়ন পদ্ধতি এই প্রতিষ্ঠানে গুরুত্ব দিয়েই পালন করা হয়। সমন্বয়ন বা রিকনসিলিয়েশনে গ্রাহক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকে। যতক্ষণ সংগৃহীত কাঁচামালের সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য ও ওয়েস্টেজ বা অপচয়ের মিল হবে না, ততক্ষণ হিসাব করা হতে থাকবে। হিসাব মিলে গেলে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ওয়েস্টেজ ধ্বংস করা হয়। এমন নিরাপত্তা বিধান ও স্বচ্ছতার কারণে এই টাঁকশাল গ্রাহক প্রতিষ্ঠাগুলোর আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছে।

গোড়াপত্তনের গল্প

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দেশে কিছুদিন পাকিস্তানি টাকার প্রচলন ছিল। তখন ওই টাকাগুলোতে ‘বাংলাদেশ’ লেখা স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হতো। পাকিস্তানি মুদ্রার পরিবর্তে বাংলাদেশের মুদ্রা হিসেবে টাকার প্রচলন শুরু হয় ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ। টাঁকশালে টাকা ছাপানো শুরুর আগ পর্যন্ত ভারত, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি থেকে বাংলাদেশের নোট ছেপে আনা হতো।

সংগ্রহ নীতিমালা অনুসরণ করে একটি ভিন্ন দেশ থেকে নোট ছেপে সময়মতো আনা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বোধ করে আমাদের দেশেই নোট মুদ্রণের একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নোট ছাপার জন্য একটি প্রেস স্থাপনের ব্যাপারে ১৯৮৩ সালে একনেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। তবে উদ্বোধনের আগে ১৯৮৮ সালেই পরীক্ষামূলকভাবে ১ টাকা ও ১০ টাকার নোট ছাপানো হয়েছিল।

প্রথম দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকল্প হিসেবেই এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেকের অনুমোদনের পর অর্থ মন্ত্রণালয় নোট মুদ্রণের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্পন্ন করে। পরে যৌথ মূলধন কোম্পানির অনুমোদন নিয়ে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যার নামকরণ করা হয় ‘দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন’। শুনেছি, ‘দ্য’ নির্দেশকটি তৎকালীন অর্থসচিব ড. আকবর আলি খানের দেওয়া।

নোট ছাপানোর রীতিনীতি

বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন গ্রাহক প্রতিষ্ঠান সচরাচর বছরভিত্তিক তাদের প্রয়োজন মোতাবেক পণ্যের চাহিদা বা কার্যাদেশ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী নোটের উৎপাদন ও সরবরাহ করা টাঁকশালের পক্ষে এর আগে কখনো সম্ভব হয়নি। ৩০ বছর আগে বসানো স্বল্পসংখ্যক মেশিন দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো টাঁকশালের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সম্প্রতি আরেকটি উৎপাদন লাইনের মেশিন বসানোর পর উৎপাদনও শুরু হয়েছে। মেশিনের স্বল্পতার জন্য কয়েকটি মূল্যমানের নোট একই সময়ে মুদ্রণ করা সম্ভব হয় না; একটি নোট ছাপাতে প্রায় ৩০ পর্যায় পার করতে হয়। নোট উৎপাদনের পরিমাণ নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিভিন্ন অফিসের প্রয়োজনমতো বিভিন্ন মূল্যমানের নোটের চাহিদা জানালে টাঁকশালের ভল্ট থেকে তা সরবরাহ করা হয়।

টাঁকশাল হলো কোম্পানি

১৯৯২ সালে প্রকল্প থেকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব কিছুটা কমে এই প্রতিষ্ঠানের ওপর। কর্তৃত্ব চলে যায় পরিচালনা পর্ষদের হাতে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিত সাত সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদ টাঁকশাল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এই পরিচালনা পর্ষদ প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রতিনিধিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এই পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। টাঁকশালের পুরো মূলধন বাংলাদেশ ব্যাংক জোগান দিয়েছে।

৯ ধরনের নোট

বাংলাদেশে ৯টি মূল্যমানের কাগজি নোট রয়েছে; অবশ্য বর্তমানে ১ টাকা মূল্যমানের কাগজি নোট আর ছাপানো হয় না। বাকি নোটগুলো গাজীপুরে অবস্থিত সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনে ছাপা হয়ে থাকে। এ ছাড়া সব স্মারক নোটও এই টাঁকশালেই মুদ্রিত। উচ্চ মূল্যমানের নোটগুলো জাল হয় বলে এগুলোর নকলরোধে বেশি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের সংযোজন করা হয়ে থাকে। কম মূল্যমানের নোটগুলো অপেক্ষাকৃত বেশি হাতবদল হয় এবং এই নোটগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেলেও বদলে নেওয়ার জটিলতায় কেউ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় না। এসব বিবেচনায় কম মূল্যমানের কাগজি নোটের পরিবর্তে ধাতুর তৈরি কয়েন বিদেশ থেকে আমদানি করে ইস্যু করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের জনগণ কয়েন ব্যবহারে একেবারেই অভ্যস্ত নয় এবং কয়েন ব্যবহারের অপরিহার্যতা আমাদের দেশে এখনো সৃষ্টি হয়নি।

টাঁকশালের প্রায় ১ হাজার কর্মচারী–কর্মকর্তার পরিশ্রমে যে নতুন কচকচে নোট উৎপাদন হয়, সেই নতুন নোটে বেতন হয় না বলে একটু আক্ষেপ দেখেছি তাঁদের মধ্যে। যে টাকা তাঁরা তৈরি করেন, সেই টাকা ভুলক্রমে বাসা থেকে অফিসে প্রবেশের সময় সঙ্গে পাওয়া গেলে তার জন্যও তাঁদের শাস্তি ভোগ করতে হয়। অধিকাংশ কর্মচারী, কর্মকর্তাকে অতিকালীন (ওভার টাইম) কাজসহ পুরো দিনটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হয়; কারণ উৎপাদন এলাকায় মুঠোফোন নেওয়া নিষিদ্ধ।

তিন দশক পেরিয়ে

টাঁকশাল এ বছর ৩০ বছর পূর্ণ করেছে, সময়ের হিসাবে যা হয়তো খুবই কম। তবে এই ৩০ বছরের মধ্যে আমি ১০টি বছর টাঁকশালে টাকা ও অন্য নিরাপত্তাসামগ্রী উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। তাই নির্জন নিরিবিলি পরিবেশে কর্মচারী, কর্মকর্তা ও তাঁদের পোষ্যদের সঙ্গে এক পরিবারভুক্ত হয়ে সময় কাটানোর জন্য টাঁকশালের ওই চাকরিজীবনটুকু নিজের কাছে কিছুটা আলাদা মনে হয়। এ ছাড়া এই সময়েই রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে পার্থিব জগতে মানুষের সবচেয়ে প্রিয় ‘টাকা’ মুদ্রণের সুযোগ পেয়েছি। তবে টাকা তৈরির অভিজ্ঞতা কোনো কাজে লাগে না বলে অবসর জীবনে নিষ্কর্মা বনে গেছি!