চিলেকোঠার ক্যাকটাস

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মকবুল সাহেবের মেজাজ তিরিক্ষি। আজ তাঁর বাড়ির ছাদে বড় ধরনের অঘটন ঘটেছে। এ বাড়িতে ২৭ বছরে যা হয়নি, আজ তা–ই হয়েছে। মকবুল সাহেব নিজ হাতে বাড়ির ছাদ সাজিয়েছেন। প্লাস্টিকের ড্রামে সবজির চাষ শুরু করেছেন। শোনা যাচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যে সেখানে মাছের চাষও শুরু করবেন। তাঁর বিশ্বাস, এমন একটা সময় আসবে, যখন সবজি-মাছ কিছুই তাঁকে বাজার থেকে কিনতে হবে না। ছাদে এলেই সব মিলবে। তিনি মাংস খান না, নইলে মুরগির একটা ছোট্ট ফার্ম গড়ে তুলতেন ছাদের এক কোনায়।

ছাদে ফুলের গাছ ১৫টির বেশি হবে না। তবে সব দুর্লভ। তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এগুলো সংগ্রহ করেছেন। দামি পোশাক, দামি ফার্নিচারের প্রতি তাঁর আকর্ষণ সামান্য। তুলনায় গাছপালার প্রতি আগ্রহ ও দরদ সীমাহীন। প্রথম বেতনের টাকা পেয়ে স্ত্রী রাবেয়ার জন্য একটা ক্যাকটাস কিনে এনেছিলেন। সবুজ বলের মতো গোল আর সুচের মতো ধারালো কাঁটাযুক্ত গাছটা ছিল লালরঙা টবের মধ্যে। তখন নিজের বাড়ি ছিল না বলে শোয়ার ঘরের জানালার পাশে সাজিয়ে রেখেছিলেন রাবেয়া। একটা গাছ তাঁদের সংসারের সুখ-দুঃখের সঙ্গী ও সাক্ষী হয়ে ছিল এত বছর, সেটিই আজ জাহিদের অসাবধানতায় পায়ের তলায় পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।

আমি আর জাহিদ মকবুল সাহেবের চিলেকোঠার ভাড়াটে। সে সুবাদে তাঁর সমৃদ্ধ ছাদে আমাদের অবাধ বিচরণ। তিনি আমাদের স্বাধীনতাও দিয়েছিলেন ছাদে চলাফেরার। তাই বলে এত বড় ক্ষতি তিনি মেনে নেবেন কেন!

আমাদের ডাক পড়েছে তাঁর বসার কক্ষে। জাহিদের নাকি আমার—কার বুক বেশি দুরুদুরু করছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। মকবুল সাহেব আজ জজ সাহেবদের মতো পোশাক পরেছেন। তাঁকে দেখতেও লাগছে বিচারকের মতো। নাকি এসব আমাদের ভীত চোখের ভ্রম। সে যা–ই হোক, রায় তিনি দেবেন এবং সেটি যে আমাদের বিপক্ষে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সামান্য ভূমিকা শেষে গাছের প্রসঙ্গ উঠল। জাহিদের মুখে রা নেই। আমিও যথেষ্ট বিচলিত। তবু চুপ করে থাকা যায় না। নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া উপায় নেই! কিছু বলতে যাব, তার আগেই যূথী হাজির। আমাকে থামিয়ে আর তার বাবাকে বিস্মিত করে জানাল, গাছটা নাকি সে–ই নষ্ট করেছে। একটা কঠিন প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ হচ্ছিল না। বই হাতে ছাদে গিয়েছিল পড়বে বলে। পড়ার সময় হাঁটতে গিয়ে গাছের ওপর পাড়া লেগে এ অবস্থা হয়েছে। ঘটনার নিখুঁত বর্ণনা শুনে যূথীকে তখন বড় মাপের গল্পকার মনে হচ্ছিল। জাহিদের মুখে স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে এসেছে। যূথীর ঠোঁটের কোণেও মিষ্টি হাসি। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। যূথীকে পছন্দ করি আমি আর ও কিনা জাহিদের পক্ষে সাফাই গাইল!

বিষণ্ন মনে ছাদের ওপর পায়চারি করছি। এ সময় রোজ যূথী আসে। অথচ আজ আসছে না কেন? মানুষ একটা অন্যায় করলে ধারাবাহিকভাবে করতেই থাকে। কাল মিথ্যা বলে যূথী যে অন্যায় করেছে, আমাকে নিরাশ করে হয়তো তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে! যূথীর বদলে জাহিদকে দেখে মেজাজ চরমে পৌঁছাল। ওর কারণেই সব কেমন ওলট–পালট হয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দাদের মতো রহস্যময় হাসি দিয়ে জাহিদ আমার হাতে তিন লাইনের একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। যূথীর লেখা—কীভাবে তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম দেখেছ? জাহিদ ভাই দোষী প্রমাণিত হলে তোমাকে নিশ্চয় একা জামাই আদরে এ বাড়িতে রাখত না। এমন একটা ছাদওয়ালা বাড়ি আর মিথ্যেবাদী মেয়ে তখন কোথায় পেতে

খুলনা