লকার নম্বর ৩৩

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

‘আপনার জন্য দুটি সংবাদ আছে। একটা ভালো, অন্যটা খারাপ। কোনটা আগে শুনতে চান?’

রোজা অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘খারাপটা।’
মানুষ হিসেবে সে যথেষ্ট নেতিবাচক। খারাপটা যে আগে জানতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রোজা অবাক হয়ে লক্ষ করল, আজ তার ভালো খবরটা জানতে ইচ্ছা করছিল। খারাপ খবরটা নয়। সে যে হঠাৎ এমডির রুমে ডাক পেয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে, এটাই বিশাল দুঃসংবাদ।
তাদের এমডির নাম আবরার। ছয় ফুট লম্বা, অসম্ভব রূপবান একজন মানুষ, চরিত্রের কাঠিন্যে যা পুরোপুরি ঢাকা পড়েছে। তিনি কাঁটায় কাঁটায় দশটায় অফিসে ঢোকেন। ঠিক ছয়টায় বেরিয়ে যান। যাওয়া আর আসার এই দুই সময়ে সবাই দম বন্ধ করে নিজ নিজ আসনে বসে থাকে।

রোজার অন্তত তা–ই মনে হয়। ছয় মাস হলো সে এখানে যোগ দিয়েছে। প্রতিদিনই বিল–সংক্রান্ত কাগজপত্র স্বাক্ষর করাতে দু–একবার তাকে এই কক্ষে আসতে হয়। সে ভয়ে ভয়ে কাগজ–কলম এগিয়ে দেয় আর মনে মনে দশবার বলে, ‘তোকে দেখলেই আমার গা জ্বলে যায়।’

আবরার স্যার স্বাক্ষর শেষে কাগজ–কলম এমনভাবে ছুড়ে দেন, রোজার মনে হয় সে একটা ডাস্টবিন। কেন একটা মানুষ এত খারাপ ব্যবহার করবে, তার মাথায় ঢোকে না। কাজ শেষ হলে সে নিশ্চয়ই খোশগল্প করতে বসে যেত না।

টেবিলে আঙুলের টোকায় রোজা বাস্তবে ফিরে এল। সাদা একটা কাগজে চোখ বুলিয়ে আবরার স্যার আঙুলের ডগা দিয়ে রোজার দিকে ছুড়ে দিলেন। ‘আপনি মনে হয় জানেন, আমাদের কোম্পানি এই মুহূর্তে প্রচুর লোকসানের মধ্যে আছে। গত কয়েক দিন চিন্তাভাবনা করে আমাকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। চিঠিটা ভালো করে পড়ুন। নিরুপায় হয়ে আমরা আপনাকে চলে যেতে বাধ্য করছি।’

রোজা চিঠিটা ধরে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল। আজ সকালে অফিসে আসার সময় সে কল্পনাও করেনি দিনটা এমন বিশ্রীভাবে পাল্টে যাবে। মাত্র ছয় মাসেই এখানকার পরিবেশের সঙ্গে খুব ভালোভাবে মিশে গিয়েছিল। সহকর্মীরাও খুব ভালো। তা ছাড়া বিশেষ একটি কারণে এই দুঃসংবাদটা তাকে আরও বেশি কষ্ট দিচ্ছে।

ঘটনাটা শুরু হয়েছিল কাজ শুরু করার দুই সপ্তাহ পর। একদিন দুপুরের খাবার সেরে নিজের কিউবিকলে ফিরে সে ডেস্কের ওপর একটা খাম পড়ে থাকতে দেখল। নীল খামটার কোনার দিকে লতাপাতা আঁকা। কৌতূহল নিয়ে খামটা খুলে রোজা অদ্ভুত একটা চিঠি পেল। শুরুই হয়েছে এভাবে,

‘আজকে থেকে আমরা গল্প করব, ঠিক আছে রোজা? তুমি লিফটে উঠতে ভয় পেয়ো না। গত সপ্তাহে সার্ভিসিং করানো হয়েছে।

নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে জানতে চাও? এখনই সব বলা যাবে না। শুধু জেনে রাখো, যেদিন, যে মুহূর্তে আমি তোমাকে প্রথম দেখেছি, সেই মুহূর্ত থেকে আমার হৃদয় তোমার কাছে গচ্ছিত রেখেছি। যত্ন করে রেখে দিয়ো কিন্তু, ঠিক আছে?

আমাকে এই চিঠির উত্তরে লিখতে ভুলবে না। লেখার পর আর্কাইভ রুমের ৩৩ নম্বর লকারে রেখে এসো। আমি খুঁজে নেব।

ইতি

পত্রলেখক’

ভীত হয়ে চিঠিটা ড্রয়ার রেখে রোজা পুরো অফিসে একবার চোখ বুলিয়ে ফেলল। চল্লিশের বেশি পুরুষ সহকর্মীর মধ্যে সে কীভাবে পত্র লেখককে খুঁজে পাবে।

প্রথম চিঠিটার উত্তর দিতে রোজা সময় নিয়েছিল তিন দিন। এরপর থেকে শুরু হলো তার এই চিঠির কথোপকথন। পত্র লেখক এবং ৩৩ নম্বর লকার সাক্ষী হয়ে আছে রোজার কত শত হাসি–কান্নার। বহুবার তার ইচ্ছা হয়েছে পত্র লেখককে দেখার। কিন্তু অনিশ্চয়তার অদ্ভুত এক ভয় তাকে আটকে রেখেছিল। তাই ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটানোর সাহস দেখায়নি। এভাবেই অচেনা এক মানুষের প্রতি গভীর আবেগ নিয়ে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আর এখন তো তাকে চেনার সুযোগটা পর্যন্ত সে পাচ্ছে না। অজানা অভিমানে রোজার চোখে পানি চলে আসছিল। দাঁতে দাঁত চেপে কান্নাটা হজম করে চিঠি হাতে সে উঠে দাঁড়াল। হৃদয়হীন একটা দানবের সামনে সে চোখের পানি ফেলবে না।

‘আচ্ছা স্যার। আমি যাই তাহলে।’ আবরার ভ্রু কুঁচকে ফোনের স্ক্রিন দেখছিল। চোখ না তুলেই বলল, ‘ভালো সংবাদটা তো জানতে চাইলেন না। ডেস্কে ফিরে যান। জানতে পারবেন।’

ভারাক্রান্ত মনে রোজা নিজের কিউবিকলে ফিরে এল। আজই তার শেষ কর্মদিবস। একদম বিনা নোটিশে এই নিষ্ঠুর কাজটা করার কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল? ঘৃণাভরে চিঠিটা ডেস্কে ছুড়ে ফেলতেই সে দেখল পেপারওয়েটে চাপা দেওয়া একটা নীল খাম, কোনায় লতাপাতার কারুকাজ। রোজার বুক ধক করে উঠল। কাঁপা হাতে খামটা খুলল, ভেতরে ছোট একটা চিঠি।

‘তুমি কি একটা বিষয় জানো? আমাদের অফিসের সহকর্মীদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। তাই কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলো, কারণ ৩৩ নম্বর লকারে তোমার জন্য চিঠির বদলে আংটি রাখার সময় হয়েছে। চাইলে তুমি রেজিগনেশন লেটার ছিঁড়ে ফেলে ডেস্কে বসে স্বাভাবিকভাবে কাজ করে যেতে পারো। অথবা হাসিমুখে লেটারটা গ্রহণ করে ৩৩ নম্বর লকারের দিকে যেতে পারো। তাকিয়ে দেখো, গভীর আগ্রহে আমি তোমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছি।’

রোজা চেয়ার থেকে হতভম্বের মতো উঠে দাঁড়িয়ে দেখল, করিডরের শেষ মাথায় পকেটে হাত দিয়ে ব্যগ্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে ছয় ফুট লম্বা অসম্ভব রূপবান একজন মানুষ, এত দিন পর যাকে একদম অচেনা লাগছে।

রোজা তার দিকে কয়েক মুহূর্ত গভীরভাবে তাকিয়ে থাকল, তারপর রেজিগনেশন লেটারটা ব্যাগে ভরে আর্কাইভ রুমের দিকে এগোল।

মতিঝিল, ঢাকা