রিনির প্রস্তাব পাস

আজ দেখা হবে। কিন্তু রিনি এখনো কিছু জানে না। অথচ এই দেখা করার প্রস্তাবটা রিনিই দিয়েছিল। এক মাস আগে। ওর বলার ভঙ্গিটা ছিল এ রকম—

রিনি— এই, দেখা করবা?

আমি— কবে?

রিনি— এটা কিন্তু কোনো অনুরোধ নয়, জাস্ট প্রপোজাল। তুমি কনসিডার করতে পারো, না–ও পারো।

আমি হেসে ফেললাম। রিনি হয়তো আর কষ্ট পেতে চায় না। আমি যদি অনুরোধটা রাখতে না পারি। কিন্তু আমি জানি, রিনি চাচ্ছে আমি ‘হ্যাঁ’ বলি।

তবে আমি বললাম— ঠিক আছে, জানাব।

রিনি জানিয়ে রাখল, রোববার ওর অফিসের পর একটা মিটিং আছে। এরপর ও কিছু সময় ফ্রি। ওই ফ্রি সময়টাতে রিনি দেখা করার প্রস্তাবটা দিল।

এরপর এক মাস প্রায় শেষ হয়ে এল। সেই রোববারও প্রায় চলে আসছিল। আমি রিনিকে এখনো কিছু জানাইনি।

মাঝখানে রিনি একদিন জানতে চাইল,

— কী ব্যাপার, প্রস্তাবটা কি পাস হলো? নাকি ভুলেই গেছ?

আমি বললাম— কী প্রস্তাব যেন?

রিনি কপট রাগী গলায়— বাহ্‌, ভুলে গেছ?

রোববার দেখা করার ব্যাপারটা?

আমি চুপচাপ। আবারও বললাম— দেখি, জানাব।

রিনির গলায় এবার একটু হতাশা।

বলল— আচ্ছা, জানিও।

শনিবার রাতে রিনি কেমন যেন একটু ঠান্ডা আর ভারী গলায় কথা বলছিল। পরিবারের প্রসঙ্গের জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। রিনি কথাটা তোলার সুযোগই পেল না। হুট করেই ফোন রেখে দিতে হলো। এমনও হতে পারে— রিনি হয়তো প্রসঙ্গটা তুলতে চাইছিল না। কিন্তু আমি জানি, ও শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।

রোববার সকালে। আমি তৈরি হয়েই অফিস গেলামে। আজকে রিনির সঙ্গে দেখা হবে। সকাল থেকেই একটা ভালো লাগা— গুনগুন গান আমার মনে। আমি ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছি রিনির সঙ্গে দেখা করার জন্য।

রিনির অফিস টাইম, মিটিং টাইম আমার জানা। মিটিং শেষ হওয়ার আগে দিয়ে রিনিকে ফোন দিলাম।

—এই, তুমি কি অফিসে? যেন রোববারের প্রস্তাবটা বেমালুম ভুলে গেছি।

রিনির গত রাতের ভারী গলা আর নেই, বলল,

—না, মিটিংয়ে। আজকে রোববার না!

আমি— ওহ, আর কতক্ষণ আছ মিটিংয়ে?

রিনি— এই তো আর ৩০ মিনিট।

রিনির গলার স্বরে স্পষ্ট আনন্দ। বলল,

—তুমি আসবা?

আমি— তখন, দাঁড়াও তোমাকে জানাচ্ছি। তোমার মিটিং শেষ হলে আমাকে একটা কল দিয়ো।

ঠিক ৩০ মিনিট পর রিনির ফোন। মেয়েটা সময়ের ব্যাপারে এত সিরিয়াস!

রিনি— আমার কাজ শেষ, তুমি কোথায়? রিনির গলায় ঝলমলে আনন্দ।

আমি— এখনো অফিসে, বের হতে পারছি না।

রিনি— তুমি না বললা...

আমি— শোনো, এক কাজ করো, আজ মনে হয় ম্যানেজ করতে পারব না। তুমি বাসায় চলে যাও। পরে কথা হবে।

রিনি— কী বলছ! আমি তো ভাবলাম তুমি অলরেডি রওনা দিয়ে দিয়েছ।

রিনির গলা গত রাতের মতো ভারী হয়ে আসছে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। দুপাশেই।

রিনির ধৈর্য দেখে আমি খুশি হই। অবাক হই না। ও এ রকমই।

আ— আমাকে কেউ যদি মন থেকে আমন্ত্রণ জানায়, তবেই আজকে আসব।

রিনি এবার নিশ্চিত আমি আসছি। ও যেন পুরোনো অধিকার ফিরে পেল। বলল,

—এক্ষুনি আস তুমি।

সঙ্গে রিনির আবদার— আমি কিন্তু ওয়েট করব না তোমার জন্য। তুমি আগে পৌঁছে আমার জন্য ওয়েট করবে।

রিনি যেন এক মাস ধরে অপেক্ষায় থাকার শোধ নিতে চাচ্ছে। আমি হাসলাম। রিনি আমার সেই হাসি দেখতে পেল না।

পৌঁছেই ম্যাসেজ পাঠাল রিনি।

—ওয়েটিং...

আমি উত্তর দিলাম না। একটু খারাপ লাগা ভর করল। এই মেয়েটিকে বেশির ভাগ সময়ই আমার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেক সময় চাইনি, তাও দেরি হয়ে যেত।

আমি আরও ১৫ মিনিট পরে পৌঁছালাম। রিনি মোবাইলে কী যেন মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। যাক, আমার পথের দিকে চেয়ে নেই রিনি। আমি নিজেকে গোছালাম। দ্রুত, মনে মনে।

রিনিকে খুব স্বাভাবিক লাগছে। ব্যাগটা কাঁধে নিতে নিতে বলল,

—আমাকে সারা জীবন ওয়েটই করতে হলো।

কিছুটা অভিযোগের স্বরে।

মনে মনে বললাম, তুমি এ অভিযোগটা করতেই পারে। কিন্তু এ কথাটা বলার অবস্থায় আমি নেই এখন।

রিনি আগে পৌঁছে আমাদের বসার জায়গাটা ঠিক করে রেখেছিল। আমি আবার খুশি হই। অবাক হই না। রিনি এ রকমই। কিন্তু রিনি এতটা স্বাভাবিক থাকছে কী করে? মনে হচ্ছে, গত রোববারেই দেখা হয়েছিল আমাদের, এখানেই। আজও তাই।

আমার ভেতরে মাঝ-সমুদ্রের ঝড়। ঝড়ের তোলপাড়ে আমি যেন ভাঙছি। আমি আর রিনি আজও মুখোমুখি বসে আছি ২০ বছর পর। অবিশ্বাস্য লাগছে। ওর হাতটা ধরে দেখতে পারলে হয়তো বিশ্বাস হতো। কিন্তু সেটা কি এখন সম্ভব! রিনি কি যেন বলছে। আমি পুরো মনোযোগ দিতে পারছি না। শুধু রিনিকে দেখছি। শুধুই দেখছি।

পুরোপুরি প্রস্তুত না হয়ে আমি শেষ কথাটাই বলে ফেললাম প্রথমে।

—দ্বিতীয় জন্মে আমি আমার সঙ্গে তোমাকে চাইব। আর চাইব আমাদের ফুটফুটে একটা বাচ্চা।

রিনি হঠাৎ কথা ভুলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বড় বড় ফোঁটায় ওর চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। আমি ওকে কাঁদতে দিলাম। আমি তো পারছি না। ও পারুক।

খানিক বাদে রিনি প্রসঙ্গ ঘোরালো। অনেক কথা ওর। ২০ বছর কম সময় তো নয়!

কত কথা জমেছে! কত ঘটনা, কত প্রশ্ন, কত অজানা!

রিনির কথার মাঝখানে আমি একসময় বললাম,

—আমি কিন্তু আজকে তোমাকে শুধু দেখতে এসেছি। শুধু দেখব। তোমাকে ২০ বছর দেখি না!

বিষাদ মুখে রিনি একটু হাসে। বলে,

—আমি কিন্তু অন্য কারণে এসেছি।

দমকা হাওয়ায় ঝড়ের তোড় বাড়ল। আমার ভেতরে। রিনি কি আমার মনের কথা বুঝতে পারছে!

রিনি বলল, আমি তোমার হাতটা আরেকবার ধরতে চাই।

ইচ্ছে হচ্ছে রিনিকে বুকে জড়িয়ে ধরি। মনে মনে বললাম,

—আমিও।

আমার হাতটা বাড়িয়ে দিলাম রিনির দিকে। ও আমার চোখের দিকে তাকাল, হয়তো বুঝে নিল, ক্ষণিকের জন্য ও আবার হারানো অধিকারটা ফিরে পেয়েছে।

আমি আর রিনি হাত ধরে বসে আছি। যেন অনন্তকাল পার করছি পৃথিবীর বাইরে অন্য এক পৃথিবীতে। সবকিছু থেমে আছে। কোলাহল নেই, কেউ নেই। শুধু রিনি আর আমি।

আমি বায়ান্না, রিনি পঞ্চাশ। আমরা দুজন দুইটা ছেলেমেয়ের বাবা-মা। আজ ২০ বছর পর আমরা কৈশোর থেকে মাঝ বয়স— এ দীর্ঘ সময়ের হিসাব মেলাতে চাইছি। আমার বুকে ঝড়ের তাণ্ডব চলছেই। রিনির চোখে নেমেছে বৃষ্টি। আমরা দুজনেই জানি, এ হিসাব মিলবে না। আমাদের যার যার গোছানো সংসারে ফিরে যেতে হবে।

ইতি

সূর্য (রিনির দেওয়া আমার নাম)

ঢাকা।